লাশের দুর্গন্ধ
পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে তো আসছেই। কোনো পচা মাছ? নাহ্। কোনো সবজির পচা গন্ধ? নাহ্। ইঁদুর ছুঁচো? উঁহু, তাও না। তাহলে কুকুর, বিড়াল? তাও মনে হয় না। কিসের পচা দুর্গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে! পচা দুর্গন্ধ তাও আবার একমুখী। দু’দিন ধরে প্রবহমান বাতাসেরও দিক পরিবর্তন নেই। যদি প্রয়োজনাতিরিক্ত রান্না করা মাছ- মাংস হতো কাক-পক্ষী খুঁটে কিংবা কুকুরে চেটেপুটে পরিষ্কার করত। উপশল্য কাছাকাছি নেই। মৃত গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া বা কোনো পোষ্য হলে তো লোকে এমন জায়গায় ফেলত না। মানুষ হলে তো এমন কাজ করতে পারে না। কারণ সভ্য রু-ি চশীল মানুষের কর্ম সম্বন্ধে সবাই অবগত। আর মানুষ বলেই এত দুর্গন্ধে ভরা সমাজটার দিকে একদৃষ্টে তাকালে ভাবনা হয়। সেই ভাবনা তো রতিকান্ত সর্বক্ষণ ভাবছে। ভাবছে বাড়ির উঠানের কাছে এমন কুকর্ম কে বা কারা করেছে, আর তার ভোগান্তি নিজেকে সহ্য করতে হচ্ছে। কিন্তু তা যে অসহ- নীয়! সবে মাত্র নতুন জমি কিনে তার ওপর ঘর বানিয়েছে। ধু-ধু জমির পট কিনেছে পাশে অনতিদূরে পানাভর্তি পুকুর। তার গা লাগোয়া ফনিমনসা-বনতুলসী-বাজ বরণ-ঝোপ। গুটি কয়েক খেজুর গাছ সাধু-সন্ন্যাসীর মতো ঝাঁকড়া অযাচিত অযত্নে পরিপাটিহীন ডালপালা ছড়িয়ে ধীর-স্থির শেকড় আটকে
যেন তপস্যা করছে। রাতে ওখানেই পুকুর পাড়েই মদ্যপদের আড্ডা জমে। এইতো সেদিন পঞ্চায়েত থেকেই সোলার আলো প্রকল্পের পোস্ট পুঁতে ওইখানে আলোকিত করার জন্য একদল লোক এসে ব্যবস্থা করে দিল। ওরা যে যার দলে দলে ভাগ হয়ে যায়। যে যেমন পারে আমোদে মেতে ওঠে। রতিকান্ত ভেবেছিল হয়তো নিরালা হবে। ছেলে মেয়ে মানুষ করতে ফাঁকা জায়গা কিনে ঘরের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা চেতনায় মানুষ করবে। স্বর্গেও ছুঁচো আছে। যদি সেটা জানত তবে কি আর মানুষ ভালো হওয়ার জন্য চেষ্টা করে। রতিকান্ত তো তাই আশা করে। জমির পট কেনার সময় কেউ তো এসব নিয়ে বলেনি বা সতর্ক করায়নি। ওসব কথা কেউ কাউকে বলেও না। সুযোগ পেলে গছিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত। আগেই জানলে এত ভুল করত না। একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে তো আসছেই। এতই বিদঘুটে দুর্গন্ধ!
এমনিতে সমাজ দহনের-সমাজ পরিবর্তনের, জাহান্নামের
যাওয়ার দুর্গন্ধ সবার নাকে কমবেশি লাগছে তো লাগছেই। ও ভেবেছিল এত দূর থেকে স্কুলে যাওয়ার থেকে স্কুলের কাছে জমি কিনে ঘর নির্মাণ করে সপরিবারে থাকবে। জন্মভিটায় ছোট ভাই থাকে। ওর সঙ্গে বাবা-মা থাকবে। বোনটার বিয়ে দিয়েছে ভালো বর-ঘর দেখে। বুল্টি চাকরি করে। তার বর ব্যাংকে চাকরি করে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে মা-বাবাও যদি যায় তাহলে সে পথও উন্মুক্ত। যেখানে খুশি থাকতে চাইলে থাকবে। রতিকান্ত একা থেকে সব ঠিকঠাক করছে, অল্পদিনের মধ্যে পরিবার আসবে। আর এরই মধ্যে এমন দুর্ঘটনা ঘটবে কে জানে। গতকাল রাতে একটা অটোর শব্দ শোনামাত্র রতিকান্তের ঘুম ভাঙে। জানালা খুলে দেখে সন্দেহজনক কিছু মনে হয়নি। কারণ তিনজন ব্যক্তি গামছায় মদের বোতল বাঁধা অনুমান করে স্ব-স্থানে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তা সোলার আলোয় দৃশ্যমান। এরপর আর কিছু জানে না।
সকালবেলা পুলিশের গাড়ি এলো। থানার আই.সি. ও চারজন বন্দুকধারী পুলিশকে দেখে এগিয়ে গেল।
এটা কার বাড়ি? এখানে লোক থাকে? আই. সি.বলল। -না না সবেমাত্র নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পথে। আপনি কি এখানেই থাকেন? বন্দুকধারী একজন বলল।
-হ্যাঁ স্যার। কেন বলুন তো?
-এখানে বাতাসে একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। সত্যি তো,
উম!
-হ্যাঁ স্যার আজ দুদিন। আমি তো এখানে থাকি না। বাড়ি থেকেই স্কুলে চলে যেতাম। ছুটি নিয়েছি। দুদিন আগে এই বিশ্রী দুর্গন্ধ ছিল না। ওই, ওই দিক থেকে আসছে। আসুন একটু এগিয়ে গেলে পাবেন।
-সত্যি তো! উম বাপরে! পেয়েছি। তাহলে তো এটাই মনে হয় সেটা।
-কী স্যার? রতিকান্ত বলল।
-একজন নিখোঁজ কিশোরীর পচা দেহ।
জীপ থেকে ছোকরা নেমে এলো।
-কিরে? এখানে কী? অফিসার বলল।
-আমি ঠিক জানি না স্যার। পাড়ার লোকে বলছে। এইতো সেই পানা পুকুর কেয়াঝোপের পাশে আমি ছাগল খুঁজতে এসে দেখি একটা বস্তা, তাও আবার মুখ বাঁধা। মাছি ভনভন করছে। ওই তো, ওই তো মতি আঙুল দিয়ে অবস্থান নির্দেশ করল। বস্তার মুখ বাঁধা দু-চারটে কাক কা কা করছে।
-বস্তাটা খুলে দ্যাখ তো। মতিকে বলল পুলিশ।
-না স্যার! আমার কেমন ভয় ভয় করছে।
-আরে আমরা তো আছি। খুলে দ্যাখ যাহ…।
সে অনুগত ভৃত্যের মতো ভীতু মনে ডান হাতে নাক চেপে বাম হাতে দড়ির গেরো খুলল। তারপর বস্তার বাঁধামুখ সরিয়ে দেখল, স্যার এ তো মেয়ে মানুষের লাশ! বড় বড় মাথার চুল দেখা যাচ্ছে। ততক্ষণে চারিপাশে অনেক লোক এসে ভিড় জ-ি ময়েছে। অফিসার ফোন করল, হ্যালো স্যার, পাওয়া গেছে। একজন মেয়ের লাশ। ভাকুকে পাঠিয়ে দিন। সঙ্গে আরো ডোম। ছাড়ছি। ভাকু থানায় লাশ স্থানান্তর করে। মাসে লাশ পিছু হিসাব করে দেখলে ভালো ইনকামও করে। সেও তো কামনা করে। বেশি বেশি লাশ যেন তাকে দিয়ে বহন করা হয়। তাতেই উপার্জন বেশি করা যায়। বিষপান করা, গলায় দড়ি দেওয়া, ইলেকট্রিকে আহত হওয়া, বজ্র পড়লে মৃত্যু, রেষারেষি, খুন ইত্যাদি। তবে হ্যাঁ, এখন রাজনৈতিক খুনের লাশটা বেশি বহন করে। নির্বাচন মুহূর্তে ঈশ্বর ভজনা করে। এই জন্য তার বউও ঠাকুর ঘরের সিংহাসনে লক্ষীর মূর্তিতে প্রতি বৃহস্পি তবার ধান-দুর্বা-ফুল-তুলসী দিয়ে ভক্তি ভরে পূজা দেয়। ঠাকুরের কাছে আর পাঁচজন এয়ো স্ত্রীর মতো মনস্কামনা পূরণের কথা বলে। মা, মাগো অর্থ-সম্পদে ভরিয়ে দাও মা, কৃপা করো করুণাময়ী, অভাগীর ডাকে সাড়া দাও মা। সাদা চুলে যেন সিঁদুর সিঁথিতে পরতে পারি, আমার স্বামী যেন আরো বেশি বেশি লাশ বয়ে টাকা রোজগার করে।
-আপনি তাহলে রতিকান্তবাবু?
-হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
-আপনার স্কুলের একজন ছাত্রী নিখোঁজ; আপনি জানেন না?
-আমি তো ছুটিতে আছি, জানি না তো।
-মেয়েটির বাবা নেই। মা আছেন, লোকের বাড়ি কাজ করেন। তারই মিসিং ডায়েরিতে এত তল্লাশি।
-নাম কী বলুন তো?
-শেফালী দাস। বাবার নাম স্বর্গীয় প্রফুল্ল দাস। মা অসীমা দাস।
-শেফালী! সে তো পড়াশোনায় খুব ভালো মেয়ে। খুবই মেধাবী, ক্লাসে প্রথম হয়। ওকে নিয়ে আমাদের স্কুল খুব আশা করে যে মাধ্যমিকে ভালো স্থান দখল করবে। শেফালী, কী বলছেন স্যার? কে মারল? কেনই বা মারবে?
-তেমন কিছু বলেননি। তবে কেউ না কেউ তো।
ততক্ষণে ভাকু এসে লাশ তুলে নিয়ে চলে গেল।
এলাকার বখাটে ছেলের নেতৃত্বে সে পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়। কারণ শেফালী প্রথম হয় বলে তার প্রতি দীর্ঘদিন ক্ষোভ আক্রোশ ছিল। গরিব সামান্য বিধবার মেয়ে হয়ে প্রথম হয় আর টাকাওয়ালার ছেলে বলে কি হারাতে পারবে না? প্রাণে মেরে ওই জায়গায় আমি থাকতে চাই।
কোচিং ক্লাস থেকে ফেরার পথে ডেকে নেয় মতি-সতীশ- খোকন।
-চল আমরা ওপথে যাব না। আজ মাঠ দিয়ে যাব। মাঠে খেসারি শুঁটি তুলে নিয়ে খেতে খেতে যাব। দিনের বেলায় দেখলে বকাবকি করে।
শেফালী বাধ্য হয়ে ওদের সঙ্গে আসছিল। গোধূলি পেরিয়েছে। যথেষ্ট আঁধারিতে কেউ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মতি অন্ধকারে বুকের ওড়না টেনে পশ্চাদ্ভাগে গলায় ফাঁস দিয়ে শুইয়ে দিলে সতীশ ও খোকন সাহায্য করে এবং ধর্ষণও করে। শেফালী ভাবতেও পারেনি বন্ধুরা এমন পরি- ণতি ডেকে আনবে। তারপর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে মতির বই ব্যাগে থাকা প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের পাশে কেয়া গাছের আড়ালে রেখে চলে যায়। যতই রাত বাড়ে মেয়ের চিন্তায় মুষড়ে পড়ে। সকালে থানায় মিসিং ডায়েরি করে। মাঝে তিনদিন অতিবাহিত।
অসীমা থানায় ছিল। লাশ দেখে চিনেও ছিল। উপস্থিত প্রধান মশাই বলেছিল, মামলা করে কিছু হবে না। কাউকে তো সন্দেহ করে দোষারোপ করা যায় না। লাভ কী হবে? যে গেছে গেছেই। কেঁচো খুঁড়েেত সাপ বেরোলে মেয়ের মা সামাল দিতে পারবে কি? এসব মামলা চললে অর্থ জোগান দেবে কে? তার চেয়ে বরং বড়বাবু কী বলেন?
পরদিন হতে অপেক্ষা করল না। নিজেরই উদ্যোগে দলের ছেলেপিলেরা এসে মো- মবাতি জ্বালিয়ে থানার মাঠে শোক জ্ঞাপন করে বলল, আমরা মনেপ্রাণে চাই দোষীদের কঠোর দৃষ্টান্তমূ- লক শাস্তি হোক। কে বা কারা জড়িত লাল নীল কোনো রঙের বাছবিচার না করে আমরা ফাঁসি চাই, চরমতম শাস্তি চাই। মেয়েটি মেধাবী নিঃস্ব গরিব হতদরিদ্র পরিবারের পিতৃহীন বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এসব অপরাধ আমরা সহজে মেনে নিতে পারব না। এসব হচ্ছে কেন পুলিশ প্রশাসন জবাব চাই, জবাব দাও। আর কত মায়ের কোল খালি হবে জবাব তোমায় দিতেই হবে। সাথী, বন্ধুরা দলের তরফ থেকে আমাদের ভূমিপুত্র মাননীয় বিধায়ক মহাশয়কে বলে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে দেবো। ওই অন্ধের যষ্ঠি ছাড়া ঐ মায়ের যে আর কেউ নেই। আপনারা আগামীকাল দলের এম.এল.এ. কার্যালয়ে সকাল আটটায় চলে আসুন। নির্যা-ি ততার পরিবারের জন্য আমাদের এর বেশি আর কী করার আছে। মানুষের পাশে আমরা ছাড়া আর কে আছে?
লাশ মর্গে গেল। রিপোর্টে লেখা হলো ধর্ষণ করে খুন। প্রধান শুনে তড়িঘড়ি চাঁদা তুলে শশ্মশানে নিয়ে গেল দাহ করতে। কেউ বাধা দিল না, বরঞ্চ সহযোগিতা করল পুলিশ ও এলাকাবাসী।
শিক্ষকরা এগিয়ে এলে সবই করতে পারতেন। স্বার্থান্বেষী
সমাজে অর্থহীন দুর্বল সহায়সম্বলহীনরা এভাবে প্রতিদিন কতই স্বপ্নের পথ থেকে বিচ্যুত হয় তার খবর বা দায় পুলিশ-সরকার-হৃদয়হীন মানুষ খোঁজই রাখে না। এই লাশ পচা দুর্গন্ধে আমরা বেঁচে বর্তে আছি। যেভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন রতিকান্তবাবুরা বাঁচে। রাস্তাঘাটে, আনাচেকানাচে, অফিসে, বিদ্যালয়ে, ঝোপ-অলিন্দে সর্বত্রই কতই না লাশ পড়ার অপেক্ষায় কেউ না কেউ অপেক্ষা করে আছে।