Skip to content

২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হেমন্তের হৈমন্তী

ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্ন বৈচিত্রো হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে।

শরতের সাদা মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে কখন কার্তিকের আকাশে সিদ্ধতার মাধুরি নিয়ে হাজির হয় তা হেমন্তই জানে। প্রকৃতি কন্যা হেমন্ত্রের রূপ বাংলার মানুষের কাছে খুব চেনা। আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিক এলেই যেন ঘরে ঘরে নবান্নের ধুম পরে যায়। এর পরেই যেহেতু শীতকাল। তাই এ মাস থেকে শীতের আগমনী বার্তা জোরে- সোরেই বোঝা যেতে থাকে।

হেমন্তের রাতে অসংখ্যা তারায় ভরে থাকে আকাশ। আর সকালের হালকা কুয়াশায় ভেজা শিউলি ঝরা উঠোন দেখে যে কেউ মনের সুখে গেয়ে উঠে শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন স্কুল।

রাতের বায় কোন মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়, ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল।

আর হেমন্তকে বলা হয় পাকা ধানের ঋতু। সকালের প্রথম সূর্যের আলো যখন পাকা ধানের ওপর ঝলমলিয়ে খেলে যায় তখন যেন সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত হয় বাংলার জনমানবহীন মাঠঘাট। সে খুশির আলো বিচ্ছুরিত হয় কৃষকদের ঘরে ঘরে। চারপাশ থাকে উৎসবমুখর।

একদিকে যেমন হেমন্তের হিমেল বাতাস কনকনে শীতের আগাম সতর্কবার্তা ঘোষণা করে। অন্যদিকে এ সময়ে প্রকৃতি অন্যরকম সাজে সেজে ওঠে। বর্ষার জল শুকিয়ে মাঠঘাট,

ফসলের জমি হয়ে ওঠে অনুপমা। এই রূপের টানেই তো ডিমির হননের কবি বা রূপসী বাংলার

কবি নামে পরিচিত কবি জীবনানন্দ দাশ একবার নয় বারবার তার কবিতায় হেমন্তকালকে এনেছেন।

জীবনানন্দ কখনো কার্তিকের নবান্নের দেশে তার কবিতায় বারবার ফিরে আসার আকুতি জানিয়েছেন। এ রূপের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে কবি তার ‘একটি নক্ষত্র আসে’ কবিতায় লিখেছেন, একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চলে/ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্ত্রের তারাভরা রাতে/সে আসবে মনে হয়; আমার দুয়ার অন্ধকারে।

হেমন্তকালের একটি সুন্দর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এসময় থাকে আকাশ নিটোল নীল। কোথাও কোথাও কোদালি মেঘ, কোথাও সাদা ভেলা, কোনো মেঘ নেই একজনা, কোনো ভার নেই, গর্জন নেই, বিজলি নেই, গোমড়া মুখ করে বসে থাকা নেই, থেমে থাকা নেই, যেন হাতের কাছেই কাচ-স্বাচ্ছ তুলো, যেন মই বেয়ে একটু উপরে উঠলেই হাতে ধরা যাবে- এ তো হেমন্তেরই গুণ।

সত্যি কথা বলতে, নয়ন আছে, যাদের তারা দেখে হেমন্তের অপরূপ রূণের বৈভব। ভারা উপভোগ করে হেমন্তের সংস্কৃতি।

যদিও শহরে হেমন্তের প্রকৃত রূপ দেখা যায় না, হেমন্ত এখানে নিজেকে

খোলার সুযোগ পায় না; কিন্তু গভীর গ্রামে এখনো হেমন্ত ধানের শোভায়, গানের শোভায়, উৎসবের শোভায়, পার্বণের শোভায়, নবান্নের শোভায় ফুটে ওঠে আধেক।

সেখানে সোনালী পাকা ধানের শীষে দোল খাওয়া বাতাস যেন নেচে নেচে গেয়ে যায়, ‘আজি ধানের ক্ষেতে, রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলারে ভাই লুকোচুরি খেলা’।
হেমন্তের রূপের আকৃতি পাওয়া যায় মধ্যযুগের কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম থেকে শুরু করে বৈষ্ণব পদাবলি ছুঁয়ে, গোবিন্দ দাস পেরিয়ে আধুনিক কালের বিশ্ব

কবি রবীন্দ্রনাথ কালের কবিকুন থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে ছাড়িয়ে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক এবং সময়ের তরুণতম কবির কলমেও। যুগে যুগে বাংলা সাহিত্যে

রচিত হয়েছে অসংখ্য হেমন্তের কবিতা। প্রতি বছর নানা জায়গায় হেমন্ত

উৎসব উদযাপিত হয়। হেমন্ত মেলা বসে গঞ্জে, খাটে। সড়কে, মোড়ে।

এখনো হেমন্তের অবশিষ্ট আমেজ দেখা যায় প্রকৃতির মাঝে।

হয়তো মানুষের আগ্রহ কমেছে ঋতুর বৈচিত্র্যে, প্রয়োজন কমেছে ঋতুভিত্তিক কর্মে, নাগরিক মস্তিষ্ক, নগর ইট-কাঠ, কারখানা, নগদ অর্থ ভুলিয়েছে ঋতুর রীতি-নীতি, দরকার তথাপিও প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে, সূচি মাফিক নিয়ে আসে ঋতুর এক এক পর্ব, ধাপে ধাপে বদলায় তার বৈশিষ্ট্য- এর থেকে বদলানো যাবে না, যতই বদল হয় সভ্যতা, বদল হই আমরা।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ