পেশা নির্বাচনে এখনো বাঁধার মুখে নারী
প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্ন থাকে এমন একটি পেশা বেছে নেওয়ার, যা তাকে আনন্দ দেবে, সম্মান এনে দেবে, এবং জীবনে সাফল্যের পথে নিয়ে যাবে। তবে পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই এই স্বাধীনতা পুরুষদের জন্য সহজলজ হলেও নারীদের ক্ষেত্রে সেটি এখনো বাধাগ্রস্ত। বাংলাদেশে নারীশক্তির উন্নয়নে বড় ধরনের অগ্রগতি হলেও পেশা নির্বাচনে নারীরা এখনো নানা ধরনের বাঁধার মুখোমুখি হন। পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, এবং বিভিন্ন প্রচলিত ধ্যানধারণা নারীদের এই স্বাধীনতাকে আটকে রাখে।
সামাজিক ধারণা ও প্রচলিত মানসিকতা
বেশিরভাগ সমাজে নারীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে তাদের প্রধানত পরিবার ও গৃহকেন্দ্রিক কর্মে নিয়োজিত হতে বলা হয়। এমন অনেক পেশা রয়েছে যা অনেকের মতে “নারীদের জন্য উপযুক্ত নয়’- যেমন নিরাপত্তা বাহিনী, নির্মাণকর্ম, গণমাধ্যমের প্রতিবেদক, বা বৈমানিকের মতো পেশা। এই ধারণাগুলি এখনো সমাজের একটি বড় অংশে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। ফলে অনেক নারী তাদের স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। অনেক পরিবারে এখনও নারীর পেশা নির্বাচনে স্বাধীনতা সীমিত। পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত, পরিবারের সম্মান রক্ষা করার অজুহাত, এবং বিয়ের প্রসঙ্গ আসতে থাকে। পরিবারের চাপের কারণে অনেক নারী নিজের পছন্দের পেশা বেছে নেওয়ার সাহস হারান। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও সমাজ বা পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান না অনেকেই। বিশেষ করে মফস্বল ও গ্রামাঞ্চনে এ চিত্র বেশি স্পষ্ট।
নারীদের পেশা নির্বাচনের পথে একটি বড় বাধা হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব। রাস্তাঘাটে যাতায়াত থেকে শুরু করে অফিসের পরিবেশ-সব জায়গায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। বিশেষত রাত্রিকালীন কাজের পেশায় নারীদের অংশগ্রহণে অনীহা দেখা যায়। পরিবারও নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকায় অনেক সময় তাদের পছন্দ অনুযায়ী পেশায় যোগ দিতে বাধা দেয়।
নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত। সমাজের ধারণা অনুযায়ী, নারীর উপার্জনকে এখনও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না, যা নারীদের স্বাধীনভাবে পেশা বেছে নেওয়ার পথে বড় বাধা। কিছু কিছু পরিবারে নারী উপার্জনের বিষয়টিকে সামাজিক সম্মানের সঙ্গে যুক্ত করা হয় না, বরং স্রেফ পরিপূরক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ধরনের আর্থিক ও সামাজিক বাধা পেশা নির্বাচনে নারীর স্বাধীনতার পথে বড় অন্তরায়।
সাধারণত নারীদের জন্য সেবামূলক পেশা যেমন শিক্ষকতা, নার্সিং ব্যাংকিং এবং ডাক্তারি পেশাকে উপযুক্ত মনে করা হয়। তবে শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, প্রযুক্তি, এবং সৃজনশীল বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো আরও বহু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে নারীদের জন্য ব্যাপক সুযোগ আছে। কিন্তু, পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে এসব ক্ষেত্রকে নারীদের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয় না। ফলে অনেক নারী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পছন্দের পেশায় যোগ দিতে পারেন না।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সামাজিক ও পারিবারিক প্রচলিত ধ্যানধারণা সেই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করছে। নারীদের স্বাধীনভাবে পেশা বাছাইয়ের অধিকার দিতে হলে প্রথমে পরিবার ও সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নারীদের হাতেও তুলে দেওয়া সম্ভব। নারীর ক্ষমতায়ন কেবলমাত্র আইন ও নিয়মের মাধ্যমে নয়, বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমেও সম্ভব।
সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন নারী শিক্ষার প্রদর ও নারী কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র শিক্ষাই নারীকে স্বাধীন পেশা বেছে নেওয়ার পথ দেখাতে পারে না, প্রয়োজন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে নারীদের প্রতি সমান অধিকার ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই নারীদের জন্য একটি স্বাধীন কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা সম্ভব।
পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নারীদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরি করা শুধু তাদের নয়, বরং দেশের উন্নয়নের জন্যও অভ্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নারীদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। ভাই পেশা নির্বাচনে নারীর প্রতি সমান সুযোগ ও স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে একটি উন্নত সমাজ গড়ে তোলাই হবে আমাদের লক্ষণ।