Skip to content

২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভ্রমণ পিপাসুদের টানছে রৌমারি বিল

আকাশ যেন বেড়িয় দিয়ে রেখেছে বলে ঠাহর হয়। অনেকটা বাঁক নিয়ে ভূমির বক্ষলগ্না হতে গিয়েই ছুঁয়েছে স্বচ্ছ-টলমলে জল। হিসেব অনুযায়ী জায়গাটি একটি বিল। কিন্তু এখানে আকাশ যেন কেমন নতুন। সেই তো পুরনো আকাশ। তার আবার নতুন-পুরাতন কি? তবু এখানে আকাশ ভীষণ নতুন দেখায়। সম্ভবত এই নতুনত্বই এখানে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমায়। দুই ধারে স্বচ্ছ টলমলে জল যেখানে পৌছুতে আছে পিচঢালা-আধাপাকা সড়ক। বিলটির নাম রৌমারি। জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের রৌমারী নামক এলাকায় এই বিলটির অবস্থান। সহজ ভাষায় জেলা শহর থেকে মোটে ২৫ কিলোমিটারের পথ।

কোনোদিন ছুটি পেলে পরিবার, বন্ধুবান্ধব কিংবা অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ জায়গাই বটে। ভ্রমণটাই যেন মনকে জুড়ে দিতে পারে। বিলের থইথই পানির বুক চিরে কেমন একেবেকে চলে গেছে আধাপাকা সড়ক। সেই পথে আকাশের রূপ অনুক্রমে বদলায়। সারাদিন কেমন শূন্য মনে হলেও পড়ন্ত বিকেলে যেন প্রাণের ঢল। সবাই আলাদা কিন্তু এই একটি সড়কে যেন সবাইকে একই সূত্রে গাঁথা মনে হয়। চারদিকে বিলের বিশুদ্ধ বাতাস কিছুটা উষ্ণ আবার কিছুটা শীতল। তবে সেই উদ্যতা এবং শীতলতার মধ্যে কেমন স্বাগত ভঙ্গিমা কিংবা ছোঁয়া।

সম্প্রতি বেশ নামডাক ছড়ালেও বিলটি কিন্তু নতুন নয়। জামালপুর জেলায় এমন অনেক বিল পাওয়া যাবে। তারমধ্যে রৌমারি বিলটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্ভবত এর বৈচিত্র্যের ঢঙের জন্য। রৌমারি বিল অন্তত ১০০ বছরের পুরনো। আগে বিলটির নাম ছিল রৌমারি টুপকার চর বিল। কোন এক অদৃশ্য খেয়ালে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী ঝিনাই, কাপাসটিয়ার বাহাসে এই বিলটির জন্ম তা এখন বলা মুশকিল। আর বলা গেলেও তা কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে শোনায়। কিন্তু এই ইতিহাস জানার জন্যেও।
কিছুটা আগ্রহ রাখা যেতে পারে। মাত্র ৫০ একর জমিতে বয়ে চলেছে এই বিলটি। চর অঞ্চলে কিংবা নদী তীরবর্তী স্থানের নামের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে প্রাত্যহিক জীবন কিংবা কিছুর উৎসের নাম জড়িয়ে থাকে। রৌমারিও তার। বাইরের কিছু নয়। এককালে এই বিলে প্রচুর রুই মাছ পাওয়া যেত। চৈত্র-পৌষ-মাঘ মাসে বহু মাছ পাওয়া যেত, বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে মাছ শিকার করত। আশপাশের মানুষরা নৌকা বেয়ে কিংবা ভেদে নেই কই মারতেন। আঞ্চলিক ভাষায় এই ক্রইকে সেখানে ‘রৌ’ বলে ডাকা হয়। উৎস থেকেই চিহ্নায়ক হিসেবে এই রৌমারি নামকরণ।

একশো বছরের ইতিহাসে রৌমারির সঙ্গে মানুষের সংযোগ নতুন নয়। তবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি সেই সংযোগের পথ করেছে সহজ। এই বিলে বছরের সাক মাসই পানি থাকে। বিল একসময় শুকিয়ে যায়। তাতে চিন্তার কিছু নেই। আবার কলকল শব্দে বিল ভরাট হয়ে যাবে। তবে যে সময়টা বিল শুকিয়ে যায় তখনও যেন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে। শুকিয়ে যাওয়া জায়গাতেই
সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল ফলাতে ব্যস্ত থাকেন কৃষকরা।

সেজন্যই তো বৈচিত্র্যে ঠাস্য রৌমারি বিন। আপনি বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে ঘুরতে আসতে পারেন। তাতে একঘেয়ে লাগবে না মোটেও। বরং একেক সময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসতে পারেন। এইতো কমাস আগে দেখে যাওয়া রৌমারির সঙ্গে এবারের রৌমারির মিল নেই। থাকে শুধু ঐ আকাশটি। সেখানেও নতুনত্ব ভীষণ।

ঋতু বদলায়, বদলায় রৌমারি। বর্ষায় এলেন, দেখবেন চারদিকে স্বচ্ছ জল। যেন ইস্পাতের একটা ফলা এখানে কেউ ফেলে গিয়েছে। সেই ফলার উপর ঢেউয়ের বিভ্রম জাগিয়ে ঠায় একটি বিল। দেখবেন ইতস্তত কেমন দুলে দুলে এগিয়ে চলেছে কিছু নৌকা। কিছু নৌকা আনমনে ভেসে। আপনার ইচ্ছে জাগবে একটিতে উঠবেন। সেই আশাও পূরণ হবে। এখানে চড়ে দেখার জন্য নৌকার ব্যবস্থা আছে। খরচটা বেশ কম। সড়কের পাশেই তো নৌকা আছে। নৌকায় চড়তে চড়তে গান্ধী আশ্রমটা ঘুরে আসতে পরেন। বিলের পাশেই জায়গাটি দেখিয়ে দেবে মাঝিরা। নৌকার বসে দেখার কত কি আছে। ঢেউগুলো ছোট ছোট। সেখানে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। যদি সন্ধ্যায় নৌকায় ভ্রমণ করেন তখন আরেক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ঐ সময় বিলের পানি সূর্যকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছে ঠাহর হয়। সেজন্যেই কি বিলের পানি অমন রঙিন হয়ে ওঠে?

পড়ন্ত বিকেলেও কি বিল সুন্দর নয়? এইতো দলবেঁধে পাতিহাঁসের ঝাঁক সাঁতরাচ্ছে। জেলেরা মাছ ধরছে। সেখানে কিছু শৈশব কেমন গুটিসুটি মেরে মিশে আছে তা কি বোঝা যায়? ঠিক এজন্যই বলা হয় বর্ষা কিংবা শরত এলেই রৌমারি যেন যৌবন ফিরে পায়। আকাশে পেঁজা তুলোর গোছা দেখা দিতে শুরু করে। মুহূর্তেই মন কেমন রসবিচারি হয়ে ওঠে।

শীতেও রুক্ষতা নেই এখানে। আশপাশের দিগন্তজোড়া সবুজ-সোনালি ফসল ও সরিষা ফুলের চোখ ধাঁধানো হলুদ। এখানে সময়ের বালাই নেই। শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের হাট বসে এখানে। ডাহুক, পানকৌড়ি, চখা- চখী, শামুককেচা, সাদাচিল, ঈখন। শঙ্খচিন সহ আরও অনেক প্রাণীই এখানে আছে। যদিও এখন অতিথি পাখির আগমন কিছুটা কমেছে তবুও রৌমারিতে এই সৌন্দর্য এখনো কিছুটা আছে। রাতে দেখবেন বিলের বুকে জোনাকির মতো বাতি জালিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত জেলেরা। মাথার উপর সেই আকাশ। থেকে অস্পষ্ট আলোয় দেখা দেবে রহস্য।

রৌমারি বিলের আশপাশে ঘুরে দেখার। মতো অনেক জায়গা আছে। গান্ধী আশ্রম তো আছেই। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী স্মরণে স্থানীয় গান্ধীভক্ত নাসির উদ্দিন সরকার ১৯৩৪ সালে গান্ধী আশ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। এই আশ্রমেই শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, কমরেড রবি নিয়োগী, কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীসহ অনেক বিখ্যাত মানুষের পদচিহ্ন রয়েছে এখানেই পাবেন মুক্তিসংগ্রাম যাদুঘর। এই অঞ্চলের সঙ্গে মাওলানা ভাসানীর নামটিও কিন্তু জড়িয়ে আছে। এখানেই তিনি মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছিলেন। সেসবের কিছু স্বাদ তো নিতেই পারেন।

এছাড়া আছে ঐতিহ্যবাহী ছন ও পাটখড়ি দিয়ে বানানো কুড়েঘর। রৌমারি বিলে ভ্রমণের জন্য তেমন কঠিন যাত্রাপথ অনুসরণ করতে হবে না। বরং ফেরার সময় তাজা শাকসবজি বা মাছ নিয়ে ফেরার জন্য ব্যাগ নিয়ে আসতে হবে। যদি বছরের এই সময়টিতে যান যখন নৌকাবাইচের আসর বসে তখন তা বাড়তি পাওনা। অথবা খোঁজ নিয়ে জেনে রাখলেন কোন সময় এই আসর বসে। এছাড়াও স্থানীয় অনেক খেলা ও উৎসব তো সারাবছর লেগেই থাকে। সময়টা আপনিও নির্ধারণ করে নিতে পারেন। সবটুকুই আপনার।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ