মায়াবী কাজলের ইতিকথা
কাজল শব্দটার সাথে একটা মায়া জড়িয়ে আছে। কাজল কালো চোখ পুরো কথাটা শুনতে হালকা মনে হলো খুব ভারী অর্থ বহন করে বটে। কাজল যেমন এক ধরনের ভালোবাসা অন্যদিকে এক ধরনের আকর্ষণ। কাজলের বিকল্প শুধুই কাজল। কাজল অনন্য ও অদ্বিতীয়।
এক কাজল নিয়ে কতই না গান কবিতা রয়েছে এই কাজলের প্রেমে পড়েনি এবং মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন এই কাজলকে কেন্দ্র করে কবি সাহিত্যিকরা লিখেছে গান কবিতা। তাঁদের এই গান ও কবিতা লেখায় কিন্তু কাজলের অবদান আছে বলতে হবে।
কিশোর কুমারের গাঁওয়া সেই বিখ্যাত গানের লাইন –
নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে?
কত কি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে
এরও বহু আগে ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,
‘ওগো ও কাজল-মেয়ে, উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে।’
জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’ কম বেশি অনকেই দেখেছেন?
উত্তর যদি হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে নিশ্চয়ই মনে আছে, সেখানে আদনান জিশার দিকে তাকিয়ে দুহাত ধরে বলেন সাদাত হোসাইনের কবিতার লাইন,
‘শোনো কাজল চোখের মেয়ে
আমার দিবস কাটে,
বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে।’
কবিতা থেকে গান বা সিনেমা, ওয়েব সিরিজ—সবখানে কেন কাজলের প্রসঙ্গ? কেন প্রেয়সীর কাজলকালো চোখে আটকে যায় প্রেমিকের মন?
যুগ যুগ ধরেই বাঙালি নারীর সাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে কাজল। সময়ের সঙ্গে সেই কাজলের রূপ বদলেছে। তবে কাজল কখনো বিলীন হয়ে যায়নি বরঞ্চ এর চাহিদার জায়গা বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন রঙের কাজল, স্মোকি, গ্রাফিক্যাল একেক সময় একেক ধারা চলতি। তবে আইলাইনার থেকে গ্লিটার—সবই যেনো হার মেনেছে চিরায়ত কাজলের কাছে!
যে কোন সাজের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলে কাজল । অনেক সময় একটি সাজ পূর্ণতা পায় কাজলের মাধ্যমে। কাজল করার জন্য কোন নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন হয় না আর কাজলের মায়া কোন বয়সে ত্যাগও করা যায় না।
এছাড়া, কাজল পড়ার ক্ষেত্রেও না কোন ভেদাভ এর প্রয়োজন হয় না নায়িকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকের কাছেই কাজল পরার কারনটা খানিকটা এক। যেমন – বলিউড তারকা কারিনা কাপুর ভোগ ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘কাজল না দিয়ে আমি কোথাও যাই না। আমার চোখগুলোকে কাজল দেওয়া অবস্থায় দেখতে বেশি ভালোবাসি। কাজলকে মনে হয় আমার চোখেরই একটা অংশ। আমার মনে হয়, আমি আরও বেশি আবেদনময়ী।’
কীভাবে কাজলের চল শুরু হলো
প্রাচীন ধারা অনুযায়ী, সুতি কাপড়ের লম্বা ছোট একটা টুকরো পেঁচিয়ে সেটা ঘিয়ে ভেজানো হয়। বের হয়ে থাকা অংশে জ্বালানো হয় আগুন। তারপর একটা ধাতুর পাত্র রশ্মির ওপর ধরে কালি জমানো হয়। সেই কালির ওপর সামান্য পরিমাণে তেল ( শর্ষে বা নারকেল তেল) আর চন্দন মেশানো হয়। তেল, চন্দনের সঙ্গে কালি মিশে তৈরি হয় চমৎকার সুরমা-কাজল। এরপর একটা কাপড়ের টুকরো ভাঁজ করে চিকন করে অথবা তুলা পেঁচিয়ে সেই কাজল ব্যবহার করা হতো চোখে। এ অঞ্চলের নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার মধ্যেই কাজল ব্যবহারের চল ছিল। কেননা এই সুরমা চোখের চারপাশে (ওপরে ও নিচের অংশে) দেওয়ার ফলে চোখের আশপাশের অঞ্চল ঠান্ডা লাগতো। ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে প্রচণ্ড গরমে এটি ছিল অন্যতম জনপ্রিয় প্রসাধনী।
‘নজরটিকা’ হিসেবেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় কাজল। ধারণা করা হয়, কপালের কালো কাজল শিশুকে সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এখনো এ অঞ্চলের নারীরা তাঁদের সন্তানকে ‘খারাপ নজর’ থেকে রক্ষা করার জন্য ভরসা রাখেন কাজলের টিপের ওপর।
১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত কাজল নিয়ে নানা নিরীক্ষা হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে প্রথমবারের মতো মেকআপ বিশ্বে আলোড়ন ফেলে ‘স্মোকি আই’। এর আগেও ভিন্নভাবে ছিল এই পদ্ধতি। তখন নারীরা আগের রাতে কাজল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। সারা রাত কাজল ‘স্ক্যাটার্ড’ হয়ে সুন্দর করে বেশ ছড়িয়ে পড়ত চোখের ওপরে আর নিচের অংশে। এটাকে বলা যায় তখনকার যুগের স্মোকি আই। পরদিন সেই কাজলের সাজ অক্ষুণ্ন রেখে নারী যেতেন অনুষ্ঠানে বা প্রিয়জনের কাছে। বিয়ের আগের রাতেও এভাবে মোটা করে কাজল পরার চল ছিল, যাতে বিয়ের দিন সুন্দর দেখায় চোখ। তখন যদিও এটাকে ‘স্মোকি আই’ ডাকা হতো না। এককথায় বলা যায়, স্মোকি আইয়ের একাল ও সেকাল। চোখের ওপরের পাতায় ছড়িয়ে কালো কাজল দেওয়ার প্রথাটা সামান্য ভোল বদলে এখনো প্রাসঙ্গিক। সেখান থেকেই এসেছে আইশ্যাডোর ব্যবহার। ষাটের দশকে জনপ্রিয়তা পায় ড্রামাটিক ক্যাট আই। নব্বইয়ের দশকে কেবল ওপরে কাজল দেওয়া পায় জনপ্রিয়তা। এখন ‘সিম্পল লাইনার’সহ সব রকমভাবেই কাজল দেওয়ার চল রয়েছে। এরপর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিবছরই এই কাজল দেওয়ার নানান ধরন বের হয় এবং সেই ধরন গুলো চোখেকে আরো আকর্ষণীয় ও সুন্দর করে তোলে। বিশ্বায়নের ফলে পশ্চিমা নারীর বিউটি বক্সেও ঢুকে পড়েছে বাঙালি নারীর নিজস্ব সজ্জার এই উপকরণ।
কাজলের ইন্ডাস্ট্রি কত বড়?
ভারতে যে কালার কসমেটিকের (কাজল, লিপস্টিক, লিপগ্লস, আইশ্যাডো ইত্যাদি) মার্কেট, এর ২৫ শতাংশ কাজলের। ভারতের অনেক নারী এটাকে কসমেটিক হিসেবে দেখতেই রাজি নন। তাঁরা কাজলকে ফেলেছেন মৌলিক চাহিদা আর কসমেটিকের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে। ‘ভোগ ইন্ডিয়া’র প্রতিবেদন অনুসারে, মাত্র কয়েক বছরের কাজলের ইন্ডাস্ট্রি ফুলেফেঁপে উঠেছে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতিবছর ২৯ শতাংশ করে বেড়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি। ২০১০ সালে ভারতে কাজল ছিল মাত্র ২৫০ কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। ২০১৫ সালে তা প্রায় ৯০০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছায়। আর এখন কাজল ভারতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। নাইকা ব্র্যান্ডের সিইও ফাল্গুনী নায়ার জানান, তাঁদের বেস্টসেলিং আইটেমগুলোর ভেতর একেবারে শীর্ষে কাজলের অবস্থান। আর যত ধরনের কাজলজাতীয় পণ্য আছে, এর ভেতর ৮০ শতাংশের বেশি বিক্রি হয় আইলাইনার ও কাজল পেনসিল।
তথ্য – সংগৃহীত