তরুণ যোদ্ধার মতো দাবায় লড়ছেন ৮০ বছরের রানী হামিদ
রানী হামিদ, বাংলাদেশের দাবা খেলায় একজন কিংবদন্তি। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার। ৮০ বছর বয়সে এসে বেশিরভাগ লোকেরা শারীরিক এবং মানসিক ভাটা অনুভব করে থাকেন। তারুণ্যের শক্তি ও দক্ষতা ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ৮০তম জন্মদিন পালন করা রানী হামিদ হাঙ্গেরিতে চলমান ফিদে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছেন।
বিশ্বের শীর্ষ খেলোয়াড়দের সঙ্গে কঠিন লড়াই জমিয়ে যাচ্ছেন রানী হামিদ। প্রতিপক্ষের অনেকেই তার নাতি-নাতনি হওয়ার মতো যথেষ্ট কম বয়সী। তবে দাবার বোর্ডে রানীর নৈপুণ্য, নিয়ন্ত্রণ এবং সাহসী পদক্ষেপগুলো প্রায়শই তরুণ খেলোয়াড়দেরও অবাক করে দেয়।
এবারের বুদাপেস্ট ৪৫তম বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডের চলমান রেকর্ডের তালিকায় আছে রানী হামিদের নাম। তিনি সর্বাধিক ২০টি অলিম্পিয়াডে খেলা একমাত্র দাবাড়ু। দাবা ম্যাচে অংশগ্রহণ রানীকে বিশ্ব দরবারে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
বিখ্যাত নাট্যকার ও সমালোচন বার্নার্ড শ একবার বলেছিলেন, ৮০ বছর বয়সে একজন মানুষ তার প্রয়োজনীয় সবকিছু জানতে পারে। মুশকিল হচ্ছে সেই জানা বিষয়গুলো মনে রাখা।
রানীর একটি নিখুঁত স্মৃতি রয়েছে বলে মনে হয়। প্রতিবেশীর কাছে খেলা শেখার সময় থেকে শুরু করে দাবা জীবনে তিনি যে সমস্ত জটিল পদক্ষেপগুলো আয়ত্ত করেছেন, তা এখনো স্মরণ করতে পারেন।
চলমান দাবা অলিম্পিয়াডে তিনদিন আগে তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচে বার্বাডোজের স্প্রিঙ্গার লেশাইকে হারিয়েছেন রানী। অপরাজেয় রানীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নারী দল ৩.৫-০.৫ স্কোরে বার্বাডোজকে পরাজিত করে। এরপর বতসোয়ানার রেবাতেন বোইতশেপোর বিরুদ্ধে আরেকটি জয় তুলে নেন রানী।
দেরিতে দাবা খেলা শুরু
বাংলাদেশের সিলেট শহর থেকে উঠে আসা রানী জীবনের দীর্ঘ সময় পরে এসে দাবা খেলা শুরু করেছিলেন। ৩৪ বছর বয়সে তিনি সিরিয়াসলি খেলা শুরু করেন। ততদিনে তিনি চার সন্তানের জননী। কিন্তু দাবার বোর্ডের দিকে মনোনিবেশ করার পরে দ্রুত উন্নতি করেছিলেন।
রানীর অর্জনসমূহ
রানী হামিদ ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর বাংলাদেশে জাতীয় শিরোপা জিতেছিলেন। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৩ সালে যখন তিনি ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিলেন, তখন তিনি হেলেন মিলিগানের সাথে যুগ্ম বিজয়ী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৮৪ সাল থেকে শুরু করে তিনি সমস্ত বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে খেলেছেন। ১৯৮৫ সালে ফিদে নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার (ডব্লিউআইএম) উপাধিতে ভূষিত হন। ২০১৭ সালে তিনি দিল্লিতে কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। পরের বছর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত দাবা বিশ্বকাপ ২০১৮-তে ‘সাংবাদিক চয়েস অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছিলেন।
স্বামী ছিলেন আর্মি অফিসার, বংশধরেরাও ক্রীড়াবিদ
জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন। গুরুজনরা তাকে আদর করে রানী বলে ডাকতেন। সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদকে বিয়ে করার পর তিনি রানী হামিদ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার স্বামী নিজে একজন আগ্রহী ক্রীড়াপ্রেমী ছিলেন এবং প্রায়শই সেনাবাহিনীর ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। তিনি মারা যান ২০০৮ সালে।
তাদের বংশধররাও ভালো ক্রীড়াবিদ। এক ছেলে কায়সার হামিদ সাবেক ফুটবল খেলোয়াড়, যিনি মোহামেডান স্পোর্টিং ঢাকার জার্সি গায়ে জড়িয়ে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে প্রায় এক দশক বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আরেক ছেলে সোহেল হামিদ জাতীয় স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়ন এবং তৃতীয় ছেলে শাহজাহান হামিদ ছিলেন জাতীয় হ্যান্ডবল ও ফুটবল খেলোয়াড়। চতুর্থ সন্তানের নাম জাবিন হামিদ।
রানী হামিদের আজকাল মাথায় তেমন কোনো টার্গেট নেই। তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যা যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তার সবই অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, এখন আমি খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকেই খেলি। আমি যে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ও তা কাটিয়ে উঠতে পছন্দ করি এবং এটিই আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা
রানী নিঃসন্দেহে দাবা খেলোয়াড়দের মধ্যে একটি অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব। নাজরানা খান নামের আরেক খেলোয়াড় কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ‘রানী আপা অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। এই বয়সেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াকু মানসিকতা রয়েছে উনার। খেলাধুলার প্রতি পূর্ণ নিষ্ঠা ও সাধনা না থাকলে কেউ এটা করতে পারবে না। সমস্ত অর্জনের বাইরেও রানী হামিদ এখনো একজন নম্র এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে রয়ে গেছেন, যা সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নের বৈশিষ্ট্য।
তথ্যসূত্র: দ্য সিয়াসাত ডেইলি, হায়দ্রাবাদ