অচিনপুর
সকালে হাটে দুধ বিক্রি করতে যেয়ে আজমল দেখে হাটে
লোকজন কম। দু-একজন যারা আছে তারা দোকানি। আজমল কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। মুদি দোকানদার গঙ্গারাম দোকান থেকে আজমলকে ডেকে বলল, তুই দুধ লইয়া বাজারে আইছত, গাঁয়ের কোনো খবর জানছ না?
না দাদা, কী অইছে?
আরে বেটা গাঁয়ে মেলিটারি আইছে। স্কুলে ক্যাম্প বানাইছে, তাড়াতাড়ি বাড়িত যা, দুধ বেচন লাগব না। আগে জান বাঁচা।
আজমল মিলিটারির কথা শুনেই কাঁপতে লাগল। ভয়ে ভয়ে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। চৌরাস্তার মোড়ে আসতেই সামনে পড়ল মিলিটারির দল। লম্বা গোঁফ মুখে দাড়িওয়ালা মিলিটারির কাঁধে রাইফেল দেখে দুরুদুরু করছে তার বুক। মিলিটারির সাথে থাকা গাঁয়ের বদরুল আজমলকে বলল, ওরাইছ না। আজমল, এরা ভালা মানুষ। দেশে শান্তি আননের লাইগা আইছে। তোর দুধের বালতিডা আমার আতে দে, স্যাররা দুধ ভালা পায়।
আজমলের হাত থেকে বদরুল দুধের বালতিটা নিয়ে নিল। কোনো টাকা-পয়সা দিল না। আজমলের হাত-পা ভয়ে শীতল হয়ে এল। বদরুল আজমলকে বলল, তুই চইল্ল্যা যা, আমরা ঘুইরা ঘুইরা গ্যারামটা দেখছি। আজমল বাড়িতে পৌঁছেই উঠানের কোনায় কামরাঙা গাছটার নিচে বসে পড়ল। আজমলের বউ ঘর থেকে আজমলকে দেখেই বেরিয়ে এসে বলল, কী অইছে তোমার?
আজমল কথা বলতে পারছে না। জীবনে কখনো মিলিটারি দেখেনি আজমল। হঠাৎ মিলিটারি দেখে ভয়ে মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেছে আজমলের।
আজমলের বউ ফেদর জিজ্ঞেস করে, তোমার মুখড়া এমন লাগতাছে কেরে, কী অইছে?
আজমল এবার আসে আজে বলতে লাগ- ল-গায়ে মিি লটারি আইছে। আওয়ার সময় হেরা আমার সামনে পড়ছে: ইয়া বড় গোঁফ, পরনে থাকি কাপড়, কান্ধে বন্ধুক।
কও কিতা! ডরাইছো?
দুধের বালতিভা কই? হেয়া
লইয়া গেছেগা। দক্ষিণ পাড়ার বদরুইলা আছিল মিলিটারির লগে। হেতে মিলিটারির লাইগা দুধ নিম্নেগা। ট্যাহা দিছেনা।
মিলিটারি গাঁয়ে আসার কথা মুহূর্তেই রটে গেল চারিদিকে। ক ধিনির্ভর অচিনপুরের মানুষগুলো সহজ সরল। শিক্ষার আলো ওদের জীবনে পৌঁছায়নি। আতঙ্ক আর ভয়ে ওরা ঘর থেকে বাহির হওয়া বন্ধ করে দিল। বদরুল বালতি নিয়ে পরের দিন সকালে আজমলের বাড়িতে এসে আজমলকে বলল, স্যার তোর গরুর দুধ বালাবাইছে, এহন থাইক্যা প্রতিদিন তুই গরুর দুধ দোহাইয়া রাখবি: আমি আইয়া লইয়া যায়াম।
আজমলের বউ ঘর থেকে বাহির হইয়া বলল, দুধ দেয়াম, ট্যাহা কই? ট্যাহা দেও।
আরে আজমলের বউ, তুমি বুঝ না হেরা এইদেশে আইছে আমাগো শান্তির লাইগা। আমগোর কর্তব্য হেতারার সেবা করা।
হ. সেবা করতো আইছে। আইছেতো দেশটারে ফাংস করতো, ট্যাহা দেও নইলে দুখ পাইবা না। কালকের দুধের ট্যাহা কই? আগে ট্যাহা দেও, পরে দুধ।
আজমল তার বউকে থামাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। আজমলের বউ বদরুলের সাথে তর্ক করেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে বদরুল
দুধ না নিয়েই চলে গেল। দুপুরের সূর্যটা যখন বিকেে লর পথে তখন মিলিটারি সমেত বদরুল আজম-ে লর বাড়িতে এল। আজমলকে গরুর রশি দিয়ে কামরা- তা গাছটায় বেঁধে ফেলল বদরুল। মিলিটারিরা ঘরে ঢুকে আজমলের বউকে পালাক্রমে নির্যাতন করতে আজমল হাউমাউ
লাগল। বদরুল উঠানে দাঁড়িয়ে হাসছে। করে কাঁদতে লাগল। আজমলের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠল। আশপাশের বাড়ির লোকজন মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে গেল। আজমলের বউকে নির্যাতন করে চলে গেল মিলিট- ারিরা। আজমল বাঁধা অবস্থা কান্না করছে। গাঁয়ের যুবক জগলু আজমলের বাড়ির পাশ দিয়ে জমিতে কাজ করতে যাওয়ার সময় আজমলের কান্না শুনতে পেয়ে বাড়িতে ঢুকল। আজম- লকে কামরাঙা গাছে বাঁধা দেখে বুঝতে পারল না কী হয়েছে। আজমলকে জিজ্ঞেস করল, কী অইছে চাচা, তোমাকে কেডা বাইন্ধা রাখছে?
আজমল হাউমাউ করে কেঁদেই যাচ্ছে। কোনো কথাই বলতে পারছে না। হঠাৎ জগলু ঘরের ভেতর মেয়ে মানুষের কান্না শুনতে পেল। জগলু তাড়াতাড়ি আজমলের বাঁধন খুলে ঘরে গিয়ে দেখল; আজমলের বউ ঘরের মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। জগলুর বুঝতে বাকি নেই কী হয়েছে-আজমলের বউয়ের সাথে। জগলু আজমলের বউকে ধরে বাহিরে আনল। ঠোঁদুটো কাঁপছে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর গাঁয়ের আরেক যুবক লতু এল। লতু বোবা, কানে শুনে না, কথাও বলতে পারে না। আজমলকে লতু তার অঙ্গভঙ্গি দিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল। আজমলের বউকে এক গ্লাস পানি এনে খেতে দিল লতু। আজমলের পানি পেয়ে এমনভাবে পান করল যেন বহু বছর সে পানি পান করেনি। হাঁপাচ্ছে আজমলের বউ।
আজমলের বাড়িতে হায়েনারা আক্রমণ করার সময় অধিকাংশ যুবক জমিতে কৃষি কাজে ব্যস্ত ছিল। খবর পেয়ে একে একে সবাই এল বটে, ততক্ষণে আজমলের বাড়িটা তছনছ করে চলে গেছে পশুর দল। সব যুবকরা ফুঁসে উঠল। প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে ওদের বুকে। ওদের অস্ত্র নেই। নেই প্রশিক্ষণ।
মূর্খমানুষ ওরা। জমিতে চাষবাস করেই চলে জীবন। আজমেলর বউকে সুস্থ করাই এখন ওদের প্রধান কাজ। সকলে আজমলের বউয়ের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজমলের বউ কিছুটা সুস্থ হলো। রাতে সকল যুবকরা মিলিত হলো লতুদের পুকুর পাড়ে। যার কাছে যা আছে তা দিয়েই প্রতিরোধ করবে ওরা হায়েনাদের। দা, খস্তি, কুড়াল, শাবল এসব হলো ওদের অস্ত্র। গাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় ওরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পাহারা দিতে লাগল। লতু বোবা হলেও বুদ্ধিদীপ্ত যুবক সে। সে সবই বুঝে কিন্তু কথা বলতে পারে না। দুপুর পেরিয়ে সূর্যটা বিকেলের পথে। লতু বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে সরিষা খেতের আইল থেকে গরুর জন্য ঘাস কাটছিল। মেঠোপথ
ধরে পশ্চিম দিক থেকে আসছে বদরুল। লতুর শরীরের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠল বদরুলকে দেখে। দুটি সরিষা খেতের মাঝখানে সরু পথে লুকিয়ে গেল লতু। বদরুল কাছাকাছি আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল লতু। বদরুলকে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে লতু। টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে আসে লতুর বাড়িতে। জগলুকে খবর দিল। জগলু বদরুলকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলে লতু বাধা দেয়। লতু তার অঙ্গভঙ্গিতে জগলুকে বলে, তাকে মেরে ফেললে মিলিটারিরা নির্বিচারে গাঁয়ে সকলের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাকে না মেরে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে, কয়েকদিন লুকিয়ে রাখার পর পরিস্থিতি বুঝে মেরে ফেলতে হবে। তাকে ছাড়াও যাবে না। তাকে আটকে রাখা হয়েছে সেই কথা আমরা ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে।
বদরুলকে লতুদের একটি ঘরে আটকে রাখা হলো। জগলু লতু আরো কয়েকজন যুবক ছাড়া এ খবর কেউ জানে না।
রাতে লতুদের উঠানে জগলু আর লতু সর্তক অবস্থায় বসে আছে। জোছনার রাত। বাড়ির পুব দিক থেকে দশ বারোজন যুবক লতুদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। ওদের হাতে শর্টগ- ান, পরনে হাফপ্যান্ট, মুখে খোঁচা দাড়ি। জগলু আর লতু ভয় পেয়ে গেল। যুবকদের মধ্যে একজন বলল, ভয় পেয়ো না, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। লতু আর জগলু স্বস্তি পেল। লতুদের বাড়ি খালি। লতুর বাবা জীবিত নেই, মা তার মামার বাড়িতে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা আজ এখানেই থাকবে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেহারা দেখেই লতু বুঝতে পেরেছে ওরা ক্ষুধার্ত। লতু মুরগি জবাই করল। রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ালো। লতু মুক্তিযে- াদ্ধাদের পেয়ে যেন আকাশ হাতে পেল। তার মুখে যেন এক তৃপ্তির হাসি ঢেউ খেলে যায়। খাওয়া শেষ হলে জগলু মুক্তিযোদ্বাদের সব কথা খুলে বলল। বদরুলকে আটকে রাখার কথাও জানালো। মুক্তিযোদ্ধারা চিন্তিত হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা সিন্ধান্ত নিল বদরুলকে মেরে ফেলতে হবে, তাছাড়া কোনো উপায় নেই। যে কথা সে কাজ। ভোর হওয়ার আগেই মিঠা নদীর পাড়ে বদরুলকে মেরে কাদায় পুঁতে ফেলা হলো। গাঁয়ের লোকজন টের পেল না।
গাঁয়ের বৃদ্ধ লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয় না। আজমল আর আজমলের বউকে ওদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নুকোলদের বাড়িতে রাখা হলো-কারণ বদরুলকে খুঁজে না পেলে মিলিটারিরা আজমলের বাড়িতে আক্রমণ করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধারা গাঁয়ের সকল যুবককে নদীর পাড়ে জঙ্গলে নিয়ে বন্দুক চালানো শিখিয়ে ওদের প্রত্যেককে একটা করে রাইফেল দিল। মহিলা ও বৃদ্ধ লোকদের নদীর পাড়ের গভীর জঙ্গলে একটা ছোট তাঁবু বানিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। যুবকদের আর পিছুটান রইল না। বদরুল নিখোঁজ দেখে মিলিটারিরা আজমলের বাড়িতে দলবেঁধে এল। মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই গাঁয়ের যুবকদের নিয়ে প্রস্তুত ছিল। যেইমাত্র আজমলের বাড়ি থেকে ওরা বের হতে লাগল; এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে লাগল মিলিটারিদের ওপর। দু-ঘণ্টা বিরতিহীন যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে মিলিটারি দলের সবাই নিহত হলো। মু- ক্তিযোদ্বারা আজমলের বাড়ি থেকে যুবকদের নিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পেও আক্রমণ করল। আরো ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ হলো। প্রতাপের সহিত যুদ্ধ করতে লাগল অচিনপুরের যুবকেরা। লতু গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢুকে গেল ক্যাম্প কমান্ডারের কক্ষে। লতুর অসীম সাহস আর যুদ্ধ-কৌশল অবাক করে মুক্তিযোদ্ধাদের। লতু একে একে ক্যাম্পের প্রতিটি কক্ষে ঢুকে খতম করতে লাগল নরপশুদের। একপর্যায়ে লতুর বুকে এসে লাগে শত্রুর গুলি। লতু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। লতু যুদ্ধে নিহত হলো। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা সব মিলিটারিদের খতম করে শত্রুমুক্ত করে অচিনপুর। বাকপ্রতিবন্ধী লতুর লাল রক্তে সিক্ত হলো মাটি। অচিনপুরের আকাশে উদিত হলো স্বাধীনতার সূর্য।