দুর্যোগে দুর্ভোগে নারী
বাড়ি থেকে যখন আশ্রয়কেন্দ্রে যাইয়া উঠি, তহন সকলের পরনের কাপুড় ভিজা আছেল। কাপুড় পাল্টামু যে, হেই রহম কোনো পরিবেশ আছেল না। কী করমু, বাধ্য অইয়া অনেকের মতো আমিও ভিজা কাপুড়ে রাইত কাটাইছি। ‘কথাগুলো পটুয়াখালীজেলারকুয়াকা টাউপজেলারহুইসেনপাড়াগ্রামেরগৃহবধূশামীমা আক্তারের। ২০০৯ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার পর ঘরছাড়া হয় শামীমার পরিবার। তখন তারা সপরিবারে এই আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথাই বলেছিলেন শামীমা।
আশ্রয়কেন্দ্রে শামীমাকে আরও যেসব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে সেগুলো হলো, শৌচাগার ব্যবহার করতে না পারা। গোসল করতে না পারা। একটিমাত্র শৌচাগার ছিল। আর আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল চার-পাঁচশ মানুষ। পুরুষদের কারণে মেয়েরা সেই শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেনি। শৌচাগারে যাতে যেতে না হয়, সে জন্য শামীমা পানি খাননি গোটা একদিন। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরও আরও কিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল শামীমাকে। বসতঘরটি ভেঙে যাওয়ায় বাবার সঙ্গে নতুন করে ছাপরাঘর তোলার কাজ করতে হয়েছে। ঘরের মেঝে, বাড়ির উঠোন সব কাদাপানিতে একাকার ছিল। বারবার কাদাপানি ভেঙে চলাফেরার কারণে পায়ে চর্মরোগ দেখা গিয়েছিল। জোয়ারের পানিতে গভীর নলকূপটি ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। ফলে শামীমাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে দেড় কিলোমিটার দূর থেকে নলকূপের পানি টেনে আনতে হয়েছে।
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী নতুন পাড়ার বাসিন্দা পারুল বেগম সাম্প্রতিক পাহাড়ধসে ঘরবাড়ি হারিয়ে চার সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন শহরের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে। কিন্তু সেখানে তার দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। ওই আশ্রয়কেন্দ্রে না ছিল যথেষ্ট শৌচাগার, না ছিল গোসলের ব্যবস্থা।
শৌচাগার ব্যবহারের জন্য লাইন দিয়ে থাকতে হতো। আধা কিলোমিটার হেঁটে পাশের নতুন পাড়ায় একজনের বাড়িতে গিয়ে গোসল করেন তিনি। এক বছর বয়সী ছোট ছেলের খাবার নিয়েও সমস্যায় পড়েন পারুল বেগম। আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুদের জন্য আলাদাভাবে খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় পারুল তাঁর ছেলের জন্য বাইরের দোকান থেকে সাধ্যমতো টুকটাক খাবার কিনে এনে পরিস্থিতি সামাল দেন।
আশ্রয়কেন্দ্রে শামীমাকে যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল, প্রায় একই রকম পরিস্থিতিতে পড়েন পারুল
বেগম। অর্থাৎ যেকোনো ধরনের দুর্যোগে নারীরা প্রায় একই রকম দুর্ভোগে পড়েন। তাদের ভোগান্তি পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে দরিদ্র নারীরা। তাদের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। একইভাবে শিশুরাও ভোগান্তির মধ্যে পড়ে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণাতেও এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
এসব প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ- পরবর্তী সময়ে নারীর সংসারের কাজ বেড়ে যায়। তাকে খাবার রান্না করা এবং সে জন্য জ্বালানি ও পানি সংগ্রহের জন্য অনেক বেশি কষ্ট করতে হয় ও সময় দিতে হয়। দুর্যোগের সময় নারী একদিকে যেমন গৃহস্থালির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে গৃহে পালিত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল রক্ষার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে শিশুকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এসব করতে গিয়ে অনেক নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় সাধারণত পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কমে যায় এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এ ছাড়া যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। খাবারের অভাবে বেশি কষ্ট করেন নারী ও শিশুরা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়াসহ তাঁরা নানা রোগে আক্রান্ত হন। নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষদের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় অনেক সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে যে ত্রাণ পাঠানো হয়, তা পুরুষেরা পান, নারী অবধি সেগুলো পৌঁছায় না। নারীদের সঙ্গে থাকে তাদের শিশুরা। দুর্যোগের সময় শিশুদের আবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়, তাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে পরোক্ষভাবে নারী ও শিশুরাই বেশি ক্ষতির শিকার হয়।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির শিকার মানুষের ৪ শতাংশই অন্তঃসত্ত্বা নারী। তাদের প্রায় ১৫ শতাংশ গর্ভকালীন জটিলতায় আক্রান্ত হন। গর্ভকালীন জরুরি সেবার অভাবে সন্তান প্রসবকালে অনেক নারী ও কিশোরীর মৃত্যু হয়। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হন। জেন্ডার বিবেচনায় কাউকে সুবিধার আওতার বাইরে রাখা, প্রান্তিক করে রাখা, যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার মতো নির্যাতন করার ফলে দুর্যোগ পরিস্থিতিতে এ সংকট বাড়ে।
এ প্রসঙ্গে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে জন্ম নেওয়া শিশুটির কথা উল্লেখ করা যায়, যার নাম রাখা হয়েছে সিডর। বাগেরহাটের মোংলার চিলা এলাকার সেন্ট মেরিস গির্জাসংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্রে জন্ম হয় সিডরের। ওই রাতে ছিল না কোনো ডাক্তার বা কোনো নার্স। সিডর ভূমিষ্ঠ হয়ে পানিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। তার মা সাথী সরকার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে কপালজোরে বেঁচে যায় দুজনই।
ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা আঘাত হানার পর খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নারীদের লবণমুক্ত খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার জন্যই প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়েছে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যন্ত এলাকায় নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। বিশেষ করে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে
নারী যৌন হয়রানিসহ নানা হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন।
বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বিভিন্ন সময়ে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসসহ নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কবলে পড়েছে এ দেশ। ভবিষ্যতেও এ ধরনের দুর্যোগের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু এসব দুর্যোগের কারণে নারীরা যাতে আর ভোগান্তিতে না পড়েন, তা দেখার দায়িত্ব প্রথমত সরকারের। এরপর বাকি সবার। তবে সরকার যে একবারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, তা নয়। সরকার ইতিমধ্যে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নারীরা যাতে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারেন, তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তাঁরা যাতে পুনর্বাসিত হতে পারেন, তার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এসব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। কেননা, গত বছর বেসরকারি। সংস্থা অ্যাকশনএইড পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, যাতায়াতসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্যোগ। মোকাবিলায় নারীরা পুরুষের তুলনায় ২৪ শতাংশ কম সক্ষমতাসম্পন্ন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সূচকে নারীর স্কোর ৪০ আর পুরুষের স্কোর ৫৫। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীকে সক্ষমতাসম্পন্ন করতে হলে সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে নারীবান্ধব করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে দুর্যোগে নারীর দুর্ভোগ কিছুতেই কমবে না।