Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে দ্বীপে ১৮ বছর বন্দী ছিলেন ম্যান্ডেলা

রোবেন দ্বীপের কাটাতারে ঘেরা এক কারাগারের দেয়ালে নীল রঙের বিশাল ব্যানারের ওপরে লেখা ফ্রিডম ক্যান নট বি ম্যানাকলড (স্বাধীনতাকে হাতকড়া পরানো যায় না)’। অদ্ভুত লেখা দেখলে অবাক হতেই হয়। এই লেখার নিচে নেলসন ম্যান্ডেলাসহ দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য নেতাদের ছবি। কারাগারের মূল ফটক দিয়ে তাকালে দূরে কাঁটাতারের বেড়া দেখা যায়। ফটক পেরিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ বর্গকিলোমিটারের জায়গাটি কম সময়ে হেঁটে দেখা সম্ভব নয় বলে বাসের ব্যবস্থা আছে। বাসে গাইড হিসেবে একজন থাকবেন। তিনি হয়তো একসময় এই কারাগারে বন্দিদশা কাটিয়েছেন।

আটলান্টিকের তীর ধরে বাসটি এগিয়ে যাবে। প্রথমেই বেশ বড় একটি কবরস্থান। ইতিহাস বলে, অনেক আগে কুষ্ঠরোগীদের রোবেনে দ্বীপান্তরিত করা হতো। মৃত্যুর পর তাদের এখানেই সমাধিস্থ করা হতো। রাজনৈতিক বন্দীদের অনেককেই দ্বীপের চুনাপাথর খনিতে খাটানো হতো। প্রখর তাপে সেই ধকল অনেকে সহ্য করতে না পেরেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন।

দ্বীপজুড়েই ছোট ছোট অনেক কারাগার। বেশির ভাগের দেয়াল কালো স্লেট পাথরে মোড়া। সবশেষে বি ব্লকের ৫ নম্বর সেলে এসে থামে বাস। এখানেই জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন ম্যান্ডেলা। ব্লক বি-তে প্রবেশের আগে আমাদের লম্বা একটা হলঘরে নিয়ে যাবে গাইড। ঘরটির চার দেয়াল লাগোয়া বেঞ্চ পাতা, সেগুলোতে আমাদের বসতে বলে মালাঙ্গুর। ঘরটিতে কয়েকটি দোতলা ধাতব খাট রয়েছে। এখানে আসার পর বন্দিদের জীবনের ঘটনা শোনানো হবে। সচরাচর ঘটনা হয় এমন। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে সেল পরিষ্কার করতে হয়। ছয়টায় নাশতা করে সাতটা থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত চুনাপাথরখনিতে কাজ। এরপর দুপুরের খাবার ও বিশ্রাম। দুপুর ও সন্ধ্যার মধ্যকালে বন্দীরা নিজেদের ব্লকে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। কারো শখ থাকলে সবজিবাগান করতে পারেন। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে সব বন্দীকে সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

হলঘর থেকে বের হয়ে করিডরে গেলে দুই পাশে কুঠুরির মতো ছোট ছোট ঘর পাওয়া যাবে। অবশেষে ম্যান্ডেলার সেলের সামনে আপনি। প্রায় চার বর্গমিটারের ঘর। কোনো খাট বা চৌকি নেই। সাদা রঙের গারদ। ছোট কাঠের টেবিলের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের একটি করে বাটি, প্লেট ও চামচ; ছোট একটি ওয়ার্ডরোব, টিনের লাল ঢাকনিযুক্ত আবর্জনা ফেলার বালতি। ঘুমানোর জন্য মাদুর আর একটি কম্বল।

সবাই ছোট কক্ষটির ভেতরে গিয়ে ছবি তুলেন। ইতিহাসের সাক্ষি কে এড়াতে চাইবেন। ১৯৯৮ সালে এই ঘরটিতে এসে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।

মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম হয়েও দীর্ঘদিন দমননীতি চালিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে কবজা করে রেখেছিল শ্বেতাঙ্গরা। এই বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াইয়ে নেমেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। একপর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ‘সশস্ত্র অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ আনেন শাসকেরা। গ্রেপ্তার করে তাঁকে জেলে পোরে। প্রহসনের বিচারে ১৯৬৪ সালের ১ জুন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শুরু হয় রোবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার দীর্ঘ জেলজীবন।

রোবেন দ্বীপের ঠান্ডা ভেজা বাতাস আর কারাগারের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে দীর্ঘ সময় থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন ম্যান্ডেলা। ১৯৮২ সালে তাঁকে কেপটাউনের পোলসমুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। তত দিনে কেটে গেছে ১৮ বছর। এ সময় বিশ্বজুড়েই জোরদার হতে থাকে ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবি। শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি হয় দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার। কিন্তু দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন ম্যান্ডেলা। পরে ১৯৯০ সালে ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার কথা জানান দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক। ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান ম্যান্ডেলা। পরদিনই কেপটাউনে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে অংশ নিয়ে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে চলা আমাদের সংগ্রাম এখন শেষ পর্যায়ে। আমরা স্বপ্ন দেখছি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের, যেখানে সম-অধিকার নিয়ে সবাই বাস করবে। বর্ণবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ ম্যান্ডেলার এই কথা আজও ভীষণ সাংঘাতিকভাবে প্রাসঙ্গিক।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ