প্রাচ্যের স্কটল্যান্ডে
খাসিয়া পাহাড় বেয়ে গড়ে উঠেছে শিলং শহর। এক হাজার ৪৬৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরের সৌন্দর্যে বিমোহিত না হয়ে উপায় নেই। সেখানে অহরহ চোখে পড়ে মেঘ-পাহাড়ের লুকোচুরি। এখন ঝকঝকে
আকাশ তো খানিক-বাদেই মেঘে সবকিছু ঢেকে যায়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অনিন্দ্য সুন্দর সব ঝরনা। এর মধ্যে হাজার ফুট উঁচু ঝরনাও আছে। ভাবুন তো একবার সেই দৃশ্যা
পাহাড় ঘেরা এই উপত্যকায় ইট-পাথরের দালান বেশি। একতলা-দোতলা বাড়িঘরগুলোকে দেখে মনে হয় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আটকে আছে নানা রঙের পাথরের টুকরো। আর সন্ধার পর চূড়া থেকে দেখা যায় শিলং শহরের বাসিন্দাদের ঘরে জ্বলা বাতিগুলো যেন পাহাড়ের কোলে জ্বলছে। যেন রাতের আকাশ পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে পড়েছে।
গারো পাহাড়, খাসি পাহাড়, জয়ন্তিয়া পাহাড়- এই তিন অঞ্চলকে নিয়েই গড়ে উঠেছে ভারতের উত্তরপূর্ব প্রান্তের মোট রাজ্য মেঘালয়। শিলং এই রাজ্যের রাজধানী। ইংরেজ উপনিবেশকালীন সময় শিলংয়ের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইউরোপীয় এসে বাস করতে শুরু করে, বিশেষত স্কটল্যান্ডের নাগরিকরা। তখন থেকেই এই শহরকে ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ হিসেবেও অবহিত করা হয়। এখানকার সৌন্দর্য ও স্থাপত্যেও স্কটল্যান্ডের ছাপ পাওয়া যায়।
মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশ। বেশিরভাগ বাংলাদেশিই সিলেটের তামাবিল বর্ডার দিয়েই মেঘালয়ে প্রবেশ করেন। বর্ডার ঘেঁষা ডাউকি শহর থেকে চার ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর যাত্রা আমাদেরকে পৌঁছে দেয় শিলং শহরে। যাত্রার শুরুতেই উমগট রিভার, নরছিল ফলস ও উমক্রেম ফলস ও মাওলিননং ভিলেজের দেখা মিলবে। উমগট রিজারের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, নদীতে ভাসা নৌকাটিকে মনে হচ্ছে যেন ঘোঁটি শুনেয় ভাসছে। হাজার রুপি খরচ করলে এই নদীতে ভেসে থাকা যাবে এক ঘণ্টা।
আমরা পান্তুমাই নামের যে ঝরনাকে চিনি, সেটা মেঘালয়ে পরিচিত বরহিল ফলস নামে। পান্তুমাই মূলত ছবির মতো সুন্দর সিলেটের এক সীমান্ত গ্রাম। এই ঝরনা দেখতে সিলেট শহর থেকে কত যে পাড়ি দিয়েছি তার হিসেব নেই। শান্ত এই গ্রামের সেই নীরবতা ভেঙে দূর থেকে কানে মোলায়েম পরশে কংকার তোলে ঝরনার ঝরঝর শব্দ। মেঘালয় পাহাড়জুড়ে ঘন কালচে সবুজ অরণ্যের ঠাসবুনোটের ভেতর দিয়ে শৈলশ্রেণির বুক বেয়ে নেমে এসেছে পান্তুমাই ঝরনার ধবধবে সাদা প্রবাহ। বাংলাদেশ অংশ থেকে যতটুকু এই ঝরনার মাধুর্যতা ছুঁয়েছি, মেঘালয়ে পা দিয়ে দেখেছি এর ভয়াবহতা।
শিলং শহরে যেতেই দুপুরের খাবারে জন্য ড্রাইভার গাড়ি থামালেন এশিয়ার অন্যতম পরিচ্ছন্ন গ্রাম মেঘালয়ের মাওলিননংয়ে। এই গ্রামে প্লাস্টিক ব্যবহার ও ধূমপান নিষিদ্ধ। শুধু মাওলিনংয়ের পরিচ্ছন্নতা বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা না এই গ্রামের সৌন্দর্যাও আপনাকে মুগ্ধ করবে, পুরো গ্রাম জুড়ে
রয়েছে অনেক বাগান, তাতে ফুটে থাকে নানা বাহারি ফুল। এই গ্রামের কাছেই লিভিং কট ব্রিজ। যার সৌন্দর্যও মুগ্ধ করবে। অনেক যত্ন নিয়ে কয়েকটি গাছের শেকড়কে একত্র করে তৈরি হয়েছে এই সেতু।
ডাউকি থেকে শিলং যাওয়ার পথ মোটেও ক্লান্তিকর নয়। পাহাড়ের উঁচু নীচু রাস্তা, রাস্তার পাশে থাকা ক্যাফেতে বসে মটকা চায়ে শরীর চাঙ্গা করে নেয়া, ছট করেই এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিলো, আর পুরো পথের বেশিরভাগ সময়ই মেথ আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। এভাবেই আপনি পৌঁছে যাবে শিলংয়ে। এখানকার পুলিশ বাজারই বাংলাদেশিদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। পর্যটক ছাড়াও কর্মসূত্রে বহু বাংলাদেশির স্থায়ী বাসস্থান পুলিশ বাজারের আশেপাশে। অধিকাংশ পরিবারের মূল শিকড় সিলেট জেলায়।
শিলং শহর ও এর আশেপাশে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। শিলং পিক, লেডি হায়াদ্রি পার্ক, ডন বন্ধো মিউজিয়াম, উমিয়াম লেক, ক্যাথিড্রাল মার্চ, গলফ কোর্স, সুইট ফলস, ওয়ার্ডস লেক, এলিফ্যান্ট ফলস-সহ অনেক কিছু। প্রতি বছরের অক্টবর-নভেম্বরে শিলং শহর ছেয়ে যায় চেরি ফুলে। আয়োজিত হয় বিখ্যাত চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যাল। শহরের মধ্যমণি কর্মব্যস্ত পুলিশ বাজার সংলগ্ন এলাকাতেই রয়েছে হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান-বাজার, শপিং মল, বাস টার্মিনাস, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, টুরিজম-এর অফিস। গাড়ি ভাড়া করে অথবা মেঘালয় পর্যটন দফতর আয়োজিত কন্ডাক্টেড ট্যুরে ঘুরে নিতে পারেন শিলং কেন্দ্রিক সিটি ট্যুর।
শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ‘শিলং পিক’। ৬৪৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত মেঘালয়ের উচ্চতম এই পয়েন্ট থেকে শিলং শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়। শিলং পিকের কাছেই এলিফ্যান্ট ফলস। রাজ্যের সবচেয়ে বড় ও সুন্দরী জলপ্রপাত। তিনটি ধাপে ঝরনাধারা নিচে নেমেছে। জলপ্রপাতটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দর্শনে বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যেতে হবে একেবারে নিচে। সঙ্গী হবে চেনা-অচেনা পাখির কলতান। বর্ষায় এই রূপসি করনার লাবণ্য আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
আপার শিলংয়ে অন্য দ্রষ্টব্য ইস্টার্ন এয়ার কমান্ড মিউজিয়াম। বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, আলোকচিত্র ও মডেল প্রদর্শিত হয়েছে এখানে। এছাড়া স্থানীয় মানুষের বেড়ানোর জনপ্রিয় স্থান লেডি হায়দারি পার্ক। সাজানো গোছানো এই বাগান যেন এক ফুলের সাম্রাজ্য। আরো একটি জনপ্রিয় স্থান ওয়ার্ডস লেক। পুলিশবাজার থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্ব। ১০০ বছরের পুরোনো এই কৃত্রিম হ্রদটি ফুলের বাগান ও গাছপালায় ঘেরা অতি মনোরম জায়গা। এখানকার ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল চার্চের মূল আকর্ষণ এর অভিনব স্থাপত্যশৈলী। যিশুখ্রিস্টের জীবনের নানা কাহিনি, উপাখ্যান ও ঘটনাবলিকে অবলম্বন করে অসাধারণ তৈলচিত্র আঁকা আছে।
গলফ কোর্সের সৌন্দর্য শিলংয়ের অহংকার। ৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভারতের অন্যতম পুরোনো এই গলফ কোর্সটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম। পাশেই পোলো গ্রাউন্ড। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের বিস্তার, সবুজ ঘাসের কার্পেট আর পাইন বনের শোভা- এক অনবদ্য কোলাজ। তাছাড়া শহরের ৫ কিলোমিটার দূরে যমজ দুই ফলস বিডন আর বিশপ। একই পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এই দুই জলপ্রপাত। বর্ষাকালে এরা হয়ে ওঠে অপরূপা।
মেঘালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় স্টেট মিউজিয়ামে। এখানে উপজাতিদের সমাজজীবনের প্রদর্শন ছাড়াও আছে ঐতিহাসিক সামগ্রী ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে সুইট ফলস। বহু দূরে পাহাড় থেকে প্রায় ২০০ ফুট নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ঝরনাটি।
মেঘালয়ে মূলত সবাই ঝরনার টানেই আসেন। পুরো মেঘলায়জুড়ে অসংখ্য করনা দেখা গেলেও, চেরাপুজিই যেন তীর্থস্থান। ওয়েই সাওডং ফলস, চট ফলস, সেভেন সিস্টার্স ফলস, নুকায়কালী ফলস, পি পি ফলস, ডাইছলেন ফলস মাসাওয়া ফলসসহ আরো অনেক ঝরনা দেখা যায় চেরাপুজি রেজে। এছাড়া ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ, মৌসিমাই কেভ, ইকো পার্ক, আরওয়া কেভসহ আরো নানা জায়গা তো আছেই। চেরাপুঞ্জির সেসব গল্প হবে অন্যদিন।