মেহেরবানু খানম: ঢাকার প্রথম ও আধুনিক নারী চিত্রশিল্পী
প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে গেলে, বারান্দার দাওয়ায় বসে একমনে ছবি আঁকছেন এক নারী। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে কয়েকটা নৌকা। নৌকাগুলো ঝড়ের কবলে। এই নৌকাগুলোয় একটাতে আছে আল্লাহতা’য়ালার অনুগত বান্দা। আর বাকীগুলোয়, যারা আল্লাহর বাণীকে অমান্য করেছে। তাদের নৌকাগুলো, ঝড়ের মুখে পড়েছে। এরকম একটা ছবি চলে গেলো মোসলেম ভারত পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায়। ছবিটা হাতে পাওয়ার পর, স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করলেন তার বিখ্যাত কবিতা “খেয়াপাড়ের তরণী”
সেই নারীটি হলেন আহসান মঞ্জিলের নওয়াবজাদী মেহেরবাণু খানম, যাকে বলা হয় ঢাকার প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী।
ঢাকার খাজা বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলীমুল্লাহ চামড়ার ব্যবসায় প্রভূত সম্পদ উপার্জন করেছিলেন। পরে জমিদারিও খরিদ করেছিলেন। তাঁর ছেলে আব্দুল গণি ইংরেজের কাছ থেকে নবাব উপাধিপ্রাপ্ত হন। গণি নিজের ছেলে আহসানউল্লাহর নামে আহসান মঞ্জিল নির্মাণ করিয়েছিলেন। আহসানউল্লাহ চারটি বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের একজন কামরুন্নেসা খানম। ১৮৮২ সালে আহসান উল্লাহ তাঁকে বিয়ে করেন।
কামরুন্নেসার তিন মেয়ে পরীবাণু, মেহেরবানু আর আখতার বানু। বেগমবাজারে নবাবদের পারিবারিক গোরস্থানের শিলালিপি থেকে জানা যায়, পরীবাণু ১৮৮৪ সালে জন্মেছিলেন। পরীবাণুর পিঠেপিঠি বোন মেহেরবানু। পরিস্কারভাবে তাঁর জন্ম সাল জানা যায় নি তবে গবেষকরা ভাবছেন, ১৮৮৫-১৮৮৮ এর মধ্যে জন্ম মেহেরবানুর। ১৯০০ সালে কামরুন্নেসা মারা গেলে মায়ের নামে কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েরা।
খাজা পরিবার শিক্ষার জন্য অর্থব্যয় করতেন। খাজা আব্দুল গণি কলেজিয়েট স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন, তা সত্ত্বেও এ পরিবারের পুরুষেরা বেশিদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করেননি। তবে পারিবারিক পরিবেশে সকলেই কিছু লেখাপড়া করতেন। মেহেরবানুর শিক্ষাও হয়েছিল পারিবারিক পরিবেশেই। তাঁর বিয়ে হয় ১৯০২ সালে না ১৩০৮ বাংলা সনের পৌষ মাসে। নওয়াব সলিমুল্লাহর (মেহেরবানুর সৎ ভাই) উদ্যোগে খাজা আজমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আজম ছিলেন নকা কলেজের ছাত্র। সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, জমিদার ও সমাজকর্মী হিসেবেও তিনি সুখ্যাত ছিলেন। তিনি ঢাকার পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছিলেন ১৯০৭ সালে। ঢাকা পৌরসভার কমিশনার, ঢাকা মুসলমান সমিতির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সদস্যও ছিলেন আজম। ব্রিটিশরা তাকে ১৯০৯ সালে খান সাহেব এবং ১৯১৭ সালে খান বাহাদুর খেতাব দেয়। দ্য পঞ্চায়েত সিস্টেম অব ঢাকা গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। শরৎচন্দ্রের বড় বউ উপন্যাসটিও খাজা আজম উর্দুতে অনুবাদ
করেছিলেন বড়ী বহু নামে। হেকীম হাবিবুর রহমান সম্পাদিত
উর্দু মাসিক যাদুর তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
মেহেরবানু ও খাজা আজম দম্পতি বাস করতেন দিলকুশায়। গেল শতকের প্রথম তিন দশক তাদের বাসভবনটি হয়ে উঠেছিল সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীদের মিলনস্থল। তাঁদের ছিল দুই পুত্র ও এক মেয়ে। বড় ছেলে খাজা মোহাম্মদ আদিল (১৯০৪-১৯৭৩) ছিলেন ঢাকার একজন গণমাণ্য ব্যক্তি। তিনি কবি ছিলেন, সাংবাদিক, সাহিত্যমোদী ও খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও টেনিস খেলায় তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি নারায়ণগঞ্জে রযালি ব্রাদার্সে চাকুরি করতেন। মেহেরবানুর দ্বিতীয় পুত্র খাজা আজমল জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ সালে।
খাজা আজমল পরবর্তীকালে দেশের ক্রীড়া, চলচ্চিত্র ও বেতার জগতে তারকার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকার ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সংগঠক এবং রেফারি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকা বেতার প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ঘোষক, সংবাদ পাঠক ও অভিনেতা হিসেবে জড়িত হন। ঢাকার মঞ্চ নাটকেও ছিল তাঁর অবদান। ক্রীড়া ও নাটকের সূত্রে বিশ ও তিরিশ দশকের বিশিষ্ট ব্যক্তি, জগন্নাথ কলেজের শরীর চর্চার প্রশিক্ষক অম্বুজ গুপ্তের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। খাজা আজমলের নেতৃত্বে অম্বুজ গুপ্ত, অভিনেতা টোনা রায় ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা চালান। ফলাফলে সুকুমারী (১৯২৭-২৮) নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং দি লাস্ট কিস (১৯৩১) নামের ঢাকার প্রথম নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। দ্য লাস্ট কিসে নায়ক চরিত্রে অভিনয় ছাড়াও আজমল এর চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনায় অংশ নেন।
মেহেরবানু তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। সংসার ধর্ম পালন করেও তিনি শিল্পের সেবা করে গেছেন। মোসলেম ভারত পত্রিকা এ ব্যাপারে লিখেছে, “নওয়াবাজানী মেহেরবানু খানম সাহেবা স্বামী-পুত্র-কন্যা পরিবৃৎ বৃহৎ সংসার লইয়াও যে চারুশিল্পের সেবায় মন দিতে পারিয়াছেন, ইহা তাঁহার মত এক অতি সম্ভ্রান্ত মোসলেম নারীর পক্ষে কম কৃতিত্বের বিষয় নয়।”
মেহেরবানুর দাদা নওয়াব গনি ও নওয়াব আহসানুল্লাহও চিত্ররসিক ছিলেন। বিদেশি শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে তাঁরা নওয়াববাড়িকে চিত্রময় করে রেখেছিলেন। আহসানুল্লাহ ১৮৮০। সালে উইলস নামে এক শিল্পীকে কলকাতা থেকে আনিয়ে সামিয়ানা চিত্রিত করিয়েছেন। আহসান মঞ্জিলের পাঠাগারেও চিত্রকলা বিষয়ক সচিত্র গ্রন্থ ছিল বেশ কিছু।
মেহেরবানু ঠিক কবে থেকে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন তা জানা যায়নি। তবে ১৯১৩-১৪ সালে তোলা একটি আলোকচিত্রে দেখা যায় মেহেরবানু পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত হয়ে ছবি আঁকছেন। মোসলেম ভারত বলছে, “অবসর সময় বিনোদনের জন্য তিনি যে পথ (চিত্রাংকন) বাছিয়া লইয়াছেন, ইহ্য হইতে উৎকৃষ্ট পথ আর কিছু আছে কিনা জানি না।”
মেহেরবানু খানম ছিলেন স্নেহশীল, দানশালী, শিক্ষানুরাগী ও মহীয়সী এক নারী। বাংলাবাজার এলাকায় তিনি মেয়েদের স্কুল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়াও, এতিম শিশুদের লালনপালনের প্রমাণও রয়েছে তার নামে। ১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকার নবাব পরিবারের এই বিদুষী চিত্রশিল্পী নবাবজাদী মেহেরবানু খানম মৃত্যুবরণ করেন। তার এমন বিদায়ে নবাব পরিবারের প্রত্যেক সদস্য সেদিন কেঁদেছিলেন এবং ব্যথিতও হয়েছিলেন বলে জানা যায় খাজা শামসুল হকের ডায়েরিতে। তার দাফন সম্পন্ন হয় দিলকুশা মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে।