বকরি ঈদ থেকে কোরবানির ঈদ
‘এক বছরে দুইটা খুশি আমরা মুসলমান,
একটা হইলো রমজানের ঈদ আরেকটা কোরবান’
ছোটবেলায় ঈদের সময় হলেই টেলিভিশনে এই গান শোনেননি এমন ৯০ দশকের মানুষ কমই থাকবেন। ইসলাম ধর্ম মতে, ঈদ বছরে দুই বার পালিত হয়। প্রথমটা ঈদুল ফিতর, যা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের এক তারিখে পালিত হয়, আর পরেরটা ঈদুল আজহা, যেটা জ্বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে পালন করা হয়।
ঈদুল আজহা মূলত আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফজরের নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাত ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক স সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে। ইসলাম মতে ঈদুল আজহার দিনে যার যাকাত দেওয়ার সামর্থ্য আছে অর্থাৎ যার কাছে ঈদের দিন প্রত্যুষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তেল রৌপ্য বা সমপরিমাণ সম্পদ (যেমন জমানো টাকা) আছে তার ওপর ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। ভারতীয় উপমহাদেশে কোরবানি প্রথা তেমন একটা পুরোনো নয়। । মূলত ভারতবর্ষে মুসলমানি রীতিনীতি বিকাশ ঘটেছে আরবদের মাধ্যমে। যখন ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সেনাপতি মুহম্মদ বিন কাসিম অভিযান করেন রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে। ইসলামের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে প্রসার ঘটেছে এর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও। সেসবের ধারাবাহিকতার পথ ধরেই বাংলায় মুসলমানদের ব্যাপক প্রভাব প্রতিষ্ঠাতা পায় ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে। তবে পূর্ববঙ্গে অনেকটা সময় ধরেই মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তার হয়নি। ফলে এখানে কোরবানির কথা তেমনভাবে খুব একটা শোনা যায় না।
সুলতান ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে ৭০৩ হিজরি/১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে, সিকান খান গাজী প্রথম সিলেট জয় করেছিলেন। আর মুসলমানদের সিলেট জয়ের পেছনে পরোক্ষভাবে নাকি কাজ করেছিল কোরবানি, বিশেষ করে বললে গরুর কোরবানি। যদিও এটা কতটুকু ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত তা নিয়ে ইতিহাস জোর গলায় কিছু বলে না। জনশ্রুতি আছে যে, সিলেট শহরের পূর্ব দিকের টোলটিকর অঞ্চলের বাসিনা শেখ বুরহানউদ্দিন একটি পুত্র সন্তান লাভের আশায় আল্লাহর কাছে একটি গরু কোরবানি করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। পুত্রের জন্মের পর, তিনি একটি গরু কোরবানি দিয়ে তার মানত পূরণ করেছিলেন। কিন্তু এর। পরে যে ঘটনা ঘটে সেটা হলো-কোরবানির গরুর মাংসের একটি অংশ ঘটনাক্রমে কসাইয়ের হাত থেকে চিল ছোঁ মেরে নিয়ে যায় এবং এক প্রাসাদের সামনে ফেলে দেয়, কেউ কেউ দাবি করেন এটি রাজার মন্দির, সিলেটের শাসক রাজা গৌর গোবিন্দের। এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে রাজা গরুর মৃত্যুর জন্য দায়ী অপরাধীর সন্ধানের নির্দেশ দেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় শেখ বুরহানউদ্দিনকে বাদশাহের সামনে হাজির করা হয়। শেখ বুরহানউদ্দিনের গোহত্যা স্বীকার করার পর, রাজা ক্ষোভের বশে তার ডান হাত ছিন্ন করেন এবং তার শিশুপুত্রের জীবন শেষ করেন। বুরহানুদ্দীন বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে গিয়ে সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের কাছে এর বিচার চান। সুলতান তার ভাইয়ের ছেলে সিকান্দর খান গাজীর নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। গৌর গোবিন্দ দুবার তাকে পরাজিত করেন। এরপর সুলতান তার সিপাহসালার নাসিরুদ্দীনকে যুদ্ধে যেতে নির্দেশ দেন। ঠিক সে সময়েই তিনশত ষাটজন সঙ্গী-সাথী ও মুরিদ নিয়ে বাংলায় হাজির হন হযরত শাহ জালাল (র.) এবং সিলেট অভিযানে মুসলমান সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। এবার মুসলমান সৈন্যরা জয় লাভ করেন। গৌর গোবিন্দ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং সিলেটে মুসলমানদের শাসন শুরু হয়।
ঘটনাগুলো থেকে অনুমান করে নেওয়া যায় পূর্ববঙ্গে গরু কোরবানির খুব একটা প্রচলন বোধহয় ছিল না।
তবে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল দিল্লির সুলতানদের দুর্বলতায়।
এ সময়টা বাংলা স্বাধীন সালতানাত যুগ (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)
হিসেবেই পরিচিত। সেই সময়েও যে পূর্ববঙ্গ বাংলার সুলতানদের সার্বিক নজরের মধ্যে ছিল তা কিন্তু বলা যাবে না। কেননা শাসন কেন্দ্রের মূল কেন্দ্রবিন্দু তখনও ছিল হজরত পান্ডুয়া, গৌড়, রাজমহলের মতো অঞ্চলগুলো।
তারপরেও এখানে একটু একটু পরিবর্তনের হাওয়া লাগছিল। মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য ঘটছিল। তবে তা বিশাল সংখ্যায় অবশ্যই নয়। পূর্ববঙ্গে মোগলদের আসার পর থেকে বলা যায়-সে চিত্রের রূপ কিছু হলেও পাল্টাতে শুরু করে।
ঢাকা, রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠার পর (অর্থাৎ ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দ) থেকেই এ অঞ্চলের ধর্মীয় বিষয়গুলো সেভাবে মেনে চলার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করা হয়। সেই সঙ্গে এটাও বলা অযৌক্তিক হবে না, ধর্মীয় আচার-ব্যবহার, অনুশাসনগুলো পালন করার ধারাটা যতটুকু শাসনযন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও উচ্চবিত্তরা পালন করতেন ঠিক ততটুকুই, স্থানীয় মুসলমানরা (বিশেষ করে সাধারণ মুসলমানরা) অংশগ্রহণহীনই থেকে যেতেন। এখানে সামর্থ্যের সঙ্গে অজ্ঞতারও খানিকটা যোগসূত্র থাকত বৈকি!
ক্ষমতার আসন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও, মোগলরা উদ্যাপনের চেতনা গ্রহণ করতে পিছপা হননি এবং আনন্দের উৎসব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করা থেকে বিরত ছিলেন। মোগল ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদের চাঁদ দেখা গেলে আতশবাজি পোড়ানো হয়। ঢাকায় অবস্থানরত মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের স্মৃতিকথ ায় ঈদ-উল-আজহার বিস্তৃত উৎসবের একটি বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়, যেমনটি ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
ঈদের নামাজের সমাপ্তি এবং খতিবের খুতবা শেষ হওয়ার পরে, ধনী মোগলদের জন্য সম্মানিত বক্তাকে পোশাক এবং অর্থ উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রাপ্ত অর্থ তারপর শহরে বসবাসকারী দরিদ্র ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, যাতে করে ঈদের দিন তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। আনন্দের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সাথে সাথে এলাকার পরিবেশ আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে ভরে উঠত। এই শুভ দিনটি উদ্যাপনে, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং রাজকর্মচারীরা একে অপরের সাথে দেখা করতো এবং ঈদ উপলক্ষ্যে আন্তরিক অভিনন্দন বিনিময় করত। এছাড়াও, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এই উৎসব দিবসে তাদের বন্ধু এবং প্রিয়জনদের বিনোদন দেওয়ার জন্য সামাজিক সমাবেশের আয়োজন করতেন এবং কোরবানির পর তাদের মেহমানদের নিয়ে এক বিরাট ভোজসভায় সামিল হতেন। অনুষ্ঠানে যেমন জমকালো খাবার থাকত, তেমনি বিনোদনের জন্য তুর্কি, আফগান থেকে আসা লাস্যময়ী নাচিয়েরা গান ও নৃত্য প্রদর্শন করতেন।
উৎসব চলত দু’তিন দিনব্যাপী। শিল্প-কারখানার শ্রমিকরাও এ আনন্দোৎসবে থেকে বাদ পড়ত না। তাদের উপহার সামগ্রী দিয়ে তুষ্ট করা হতো।
এর পরবর্তী সময়ে কোরবানি ঈদের তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে অনেকের ধারণা, শাসকশ্রেণি মুসলমান হওয়ায় ঢাকায় কোরবানি হতো। ক্ষমতার পালাবদলে সেই অবস্থার পরিবর্তনও হয়েছিল।
বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে চলে যাওয়ায় পতন শুরু হয় ঢাকার। ফলে ঢাকার সীমানা ও জনসংখ্যাও সঙ্কুচিত হয়ে যায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার জনসংখ্যা তিন লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। এসময় ঈদের (সম্ভবত রোজার ঈদের পাশাপাশি কোরবানির ঈদেও) মিছিল বের হতো ঢাকার নায়েব নাজিমদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের পর এ ধারাও বন্ধ হয়ে যায়। আগেই বলা হয়েছে, সেই সময় স্থানীয় মুসলমানদের ধর্ম-কর্ম পালনটা সেভাবে বলতে গেলে ব্যাপক ছিল না।
ঢাকার বাইরে কোরবানির ঈদ পালন করাটা বেশ কষ্টকর ছিল সে সময়ের মুসলমানদের জন্য। কেননা স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা তাদের মুসলমান প্রজাদের কোরবানি দিতে বাধা দিতেন। সুধাকর পত্রিকা (৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯০) সেরকমটাই জানাচ্ছে-
‘বকরি ঈদেও ঊর্ধ্বতন হিন্দু কর্মচারী এবং জমিদারদের আমলারা বগুড়ার নারহাট্টার মুসলমানদের কোরবানি দিতে দেয়নি। মুসলমানদের উচিত এ ব্যাপারে লে. গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা।’ মুসলমানদের কোরবানি করতে না দেওয়ার ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা বাড়তে থাকে। ইংরেজ সরকার তা দেখেও না দেখার ভান করত। কেননা হিন্দু-মুসলমানদের এই দ্বন্দ্ব তাদের শাসনকার্যের সুবিধার্থে একান্ত প্রয়োজন ছিল।
ঢাকায় হিন্দু-মুসলমানদের সাম্য অবস্থা বিরাজ করলেও ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলোসহ গোটা ভারতবর্ষেই গো-গত্যার বিরুদ্ধে জোট বা সমিতি গড়ে উঠেছিল। এগুলো ‘গো-হত্যা নিবারণী সভা’, ‘গো-রক্ষিণী সভা’ নামে পরিচিত ছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরবর্তী সময়ে ‘গরু কোরবানি’ ইস্যু হিসেবে থমকে পড়লে এই সম্প্রদায় অন্য বিষয়গুলো (যেমন নামাজের সময় মসজিদের সামনে কীর্তন করে যাওয়া, দুর্গাপূজার সময় বাধা দেওয়া প্রভৃতি) নতুন করে সামনে এনে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যদিও এ বিষয়গুলো কোনোটিই নতুন কিছু ছিল না। এসবের মধ্য দিয়েই হিন্দু-মুসলমান প্রায় হাজার ধরে একে অপরের প্রতিবেশী হিসেবে বাস করেছে।
সে সময়ে কোরবানির ঈদ, ‘বকরির ঈদ’ হিসেবে ভালোই পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল। সেটা এতটাই যে ঢাকার লোকজনদের কোরবানি দিতে তেমন কোনো ঝামেলা না হলেও তারা এই কোরবানির ঈদকে ‘বকরির ঈদ’-ই বলতেন।