নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময়
নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য! আচ্ছা, পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যের সংখ্যা কত? ভীষণ গোলমেলে প্রশ্ন। এই তৃষ্ণা মেটাতে একটি গ্রন্থের সন্ধান পেয়েছিলাম। নাম ‘পৃথিবীর যত সাম্রাজ্য’। লিখেছেন এ কে এম আব্দুল আউয়াল। সেই গ্রন্থে উল্লিখিত আছে ১৯৬টি সাম্রাজ্যের নাম। এই সংখ্যাটিও নাকি ঠিক নয়। অর্থ হলো আরও অনেক সাম্রাজ্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত, যেগুলো কোথাও লিপিবদ্ধ করা নেই।
রোমান সাম্রাজ্য, উসমামি সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য প্রভৃতি নাম যেমন সমাদৃত, নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য নামটি তেমন জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এই সাম্রাজ্যের আরও পরিচয় রয়েছে, সেটি ব্যার সঙ্গে-সঙ্গে সবাই বলে উঠবে ও আচ্ছা!
বলছিলাম প্রাচীন পেট্রা নগরীর কথা। সম্প্রতি জর্ডান ভ্রমণ করেছি। জর্ডান ভ্রমণ করলে কেউ পেট্রা নগরী ভ্রমণ করবে না, তা হতেই পারে না। জর্ডান ও পেট্রা অন্তর্গত অর্থে সমার্থক।
পেট্রা ভ্রমণ
পেট্রার লা মেইজান হোটেল থেকে এই প্রাচীন নগরীর দূরত্ব মাত্র ৩ মিনিটের। আমাদের মাইক্রোবাসটি এসে পার্কিং গ্রাউন্ডে থামলো। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম পাঘরের পাহাড়গুলো। গাইড ইয়াসির বললো, আমি টিকিট করে নিয়ে আসি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলো। গেটে টিকিট দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। বেশ বড় একটি চতুর। চারদিকে স্যুভেনির দোকান। একটি দোকানের নাম দেখলাম ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’।
সিনেমাও পর্যটনের অংশ। পর্যটন এমন একটি শিল্প, যে শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত একটি দেশের আপামর জনসাধারণ, সেই দেশের পথ, নদী, সাগর, পাহাড়, কৃষি, খাবার, সিনেমা, রাজনীতি, ব্যবসা, অর্থনীতি, প্রত্নসম্পদ, গাড়ি, বাসি, বাজার-হাট এক্কেবারে সব কিছু। পৃথিবীর সব দেশ, এর সবই কাজে লাগাচ্ছে। কেবল পিছিয়ে আছি আমরা। যাক সে অন্য আলাপ।
বলছিলাম হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘ইন্ডিয়ানা জোনস। দ্য লাস্ট ক্রুসেড’-এর কথা। ১৯৮৯ সালে মুভিটি মুক্তির পর পেট্রা এখন সবার আগ্রহে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সালে পৃথি বীর সপ্তম আশ্চর্যের নতুন তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে পেট্রা। ১৯৮৫ সাল থেকে পেট্রা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের আওতায় এসেছে।
স্যুভেনির চতুর থেকে এসে দাঁড়ালাম একটি ছাউনির নিচে। সেখানে গাইড আজকের ভ্রমণ বর্ণনা করলো। বেশ খানিকটা হাঁটার পথ রয়েছে। তাই যারা হাঁটতে অপারগ, তাদের জন্য পেট্রা নগরীতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোট ছোট ট্যুরিস্ট গাড়ি রয়েছে। জনপ্রতি গুনতে হবে ২৫ দিনার, যাওয়া-আসা মিলিয়ে।
আমি হেঁটে শহর দেখার দলের লোক। রওনা হলাম গাইডের পিছু পিছু। ভীষন তাপ বাইরে। একেবারে গা পুড়ে যাওয়া রোদ যাকে বলে। নিজের রোদচশমা, টুপি, পানির বোতল নিয়ে পেট্রা নগরীতে পা রাখলাম। আহা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের শহরের পথে হাঁটছি। দুচোখ ভরে চারদিকে দেখছি। ইয়াসির দ্রুত পায়ে আমার থেকে বেশ দূরে এগিয়ে গেছে। যাক সে। আচমকা মনে হলো, রোদচশমা আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। এটি পরণে আমার মনে হয়, ভ্রমণের রূপ, রস, রঙ, গন্ধ ঠিকভাবে দেখা-অনুভব করা হলো না। তাই রোদচশমা খুলে ব্যাগে ভরলাম। হ্যাঁ এই তো রহস্যময় পেট্রা নগরী।
দূরে একটি স্থাপনার সামনে ইয়াসির দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছের যাওয়ার পর সে একটি পাথরের গুহা দেখিয়ে বললো, এগুলো হচ্ছে সমাধি, এই নগরীর সাধারণ জনতার। সেগুলো আমার হাতের ডান দিকে। বামদিকে দেখিয়ে ইয়াসির বললো, এটি রাজাদের সমাধি। একটি স্থাপনায় দেখতে পেলাম চারটি অবেলিস্ক। হয়তো চার জনকে সমাহিত করা হয়েছে। পথের বাম দিকের একটি পাথরের গায়ে কিছু লেখা অঙ্কিত রয়েছে, সেই লেখাগুলো দেখিয়ে ইয়াসির বললো, পুরো পেট্রা নগরীতে এই একটি মাত্র পাথরে লেখা বর্ণ পাওয়া গেছে, যা অবেলিস্ক যুক্ত সমাধির কথা বলছে। আমার আর পাথর খণ্ডটির দূরত্ব বেশ খানিকটা। তারপরও মোবাইল ফোনের জুম অপশনে গিয়ে ছবি তুলে রাখলাম।
আমার প্রিয় অবেলিস্ক যুক্ত সমাধি। পৃথিবীর খুব কম দেশেই সমাধি জয় হিসেবে অবেলিস্কের ব্যবহার দেখা যায়। অবেলিস্কের ধারণাটি এসেছে মূলত মিশর থেকে। তবে শুরুর দিকে সমাধিতে অবেলিস্ক ব্যবহার করা হতো না। এটি স্থাপন করা হতো মন্দিরের সামনে, বাড়ির দরজায়, শহরের প্রবেশদ্বারে, অমঙ্গণকে বিতাড়িত করার জন্য। মিশরে অবেলিস্কগুলো এই উদ্দেশ্যেই স্থাপিত। পরে পশ্চিমা ও অন্যান্য দেশ এই অবেলিস্ক রীতি অনুসরণ করে সমাধি ও ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে অবেলিড স্তম্ভ রয়েছে বাহাদুর শাহ পার্ক আর চট্টগ্রাম খ্রিষ্টান সিমেট্রিতে।
চলতে চলতে পথের একপাশে দেখছি ঘোড়া নিয়ে কিছু কিছু চালক দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর পর ট্যুরিস্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে আর বলছে, ‘হর্স রাইড উইথ ইয়োর টিকিট ম্যাম’। ছোট ছোট গাড়িগুলো ছাড়া ঘোড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
কিন্তু ইয়াসির মাথা ঝাঁকিয়ে নিষেধ করলো কথা বলার জন্য। আমি আসলে স্থানীয় জনমানুষের সঙ্গে একটু কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। ইয়াসিরের নির্দেশে সে ইচ্ছে পরিত্যাগ করলাম।
চারদিক দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছি। আচমকা একটি উঁচু- নিচু রাস্তা এলো। বামদিকে হাত দিয়ে ইয়াসির দেখালো একটি পানির লাইন। পাথরের পাহাড় কেটে পানি সরবরাহের এই অভিনব পদ্ধতির জন্য আজও পেট্রা নগরী বিশ্বসেরা ও একটি বিস্ময়। শুধু জনমানুষের জন্যই নয়, পশুদের পানির সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে। এখন প্রবেশ করলাম একটি সরু গলিতে। পেট্রার বিখ্যাত সেই সরু গলিগুলো, দুপাশে বিশাল বিশাল পাথরের পাহাড় আর আঁকাবাঁকা গলিপথ। সূর্যের তাপ এখানে কিছুান কম আর পাহাড়ের ফাঁকফোঁকর গণে মৃদু বাতাস এসে গায়ে লাগলো। ভাবলাম জিরিয়ে নেই একটু।
মিনিট পাঁচেক পরেই ইয়াসির তাড়া দিলো। আবার চলতে শুরু করলাম। পাথরের গায়ে কিছু দেবতার আবস্থা মূর্তি দেখতে পেলাম। এগুলো সবই রোমান দেবতা। নাবাতিয়ানদের খুব বেশি স্থাপনা নেই, যা আছে সবই রোমানদের স্মৃতি।
পথ চলতে চলতে দেখলাম কিছু স্থাপনা ঢেকে রাখা হয়েছে, ঢেকে রাখা হয়েছে মানে চারধারে মিলের খাঁচা তৈরি করা হয়েছে। অবয়ব দেখে বোঝার জো নেই এগুলো মন্দির ছিল। আসলে সময়ের পরিক্রমায়, প্রাকৃতিক কারণে অনেক স্থাপনার চেহারাই বদলে গেছে, ভিন্ন আকার ধারণ করেছে কিংবা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। আর একটি জায়গা দেখিয়ে ইয়াসির বললো, এটি ছিল স্টেশন। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি সৈন্যমূর্তির অর্ধেক অংশ দেখতে পেলাম। দু’পা আর পোশাকের খানিক অংশ দেখে বোঝা যাচ্ছে, মনুষ্যমূর্তি। তার পাশেই রয়েছে উটের মূর্তি। সেটিও অর্ধেক।
এগুচ্ছি, অকস্মাৎ ইয়াসির বলে উঠলো, ‘ওপেন ইওর ক্যামেরা অ্যান্ড ফলো মি সাইলেন্টলি’। আমি বাধ্য শিক্ষার্থীর মতো পালন করলাম। দুই পাহাড়ের ফাঁক গলে দেখতে পাচ্ছি দারুন কারুকাজ করা একটি স্থাপনা। সরু গলি শেষ হতেই সামনে বিশাল চতুর, মেলা ট্রারিস্ট, মেলা উটের কাফেলা, গাইড চারদিকে বিশাল শোরগোল। পেট্রার সব থেকে কাঙ্ক্ষিত স্থাপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। পর্যটকরা কেউ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ উটের পিঠে ছবি তুলছেন। পুরো সিনেমার দৃশ্যের মতো লাগছে।
১৫০ ফুট উঁচু ও ১০০ ফুট চওড়া এই স্থাপনার নাম। ট্রেজারি। নির্মাণকাল মনে করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক। এই প্রাসাদটির আরবি নাম খাজানাত আল ফারাউন। এই নামটি নাবাতিয়ানদের দেওয়া নয়। স্থানীয় বেদুঈনদের দেওয়া। তাদের ধারণা হয়েছিল-ফেরাউন ও তার সৈন্যরা ইসরাইলদের পেছনে ধাওয়া করে এই পথে যেতে ফেরাউনের ধনরত্ন এই প্রাসাদের গোপন কক্ষে লুকিয়ে রাখে। বিভিন্ন সময় ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণায় ও খননে এখানে কোনো ধনরত্ন পাওয়া যায়নি। তবে, ট্রেজারি নামটি রয়ে গেছে স্থায়ীভাবে। এই প্রাসাদের ওপরের দিকে দুটি ঈগলমূর্তি
রয়েছে, এগুলো নাবাতিয়ান দেবতার প্রতিকৃতি।
আমি যে চতুরে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে বিশাল ট্রেজারি প্রাসাদের ছবি ঠিক ভালো আসে না। গাইড বললো উচু পাহাড়ের ওপর উঠলে সুন্দর ছবি তোলা যায়, তবে গুনতে হবে ৫ দিনার। দেখলাম বেশিরভাগ নারী ট্যুরিস্ট সেখানে গিয়ে ছবি তুলছেন। আমিও গেলাম। পথটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। স্মৃতি ধরে রাখা বড় বিষয়।
পাহাড় থেকে নেমে পেট্রা সিটি সেন্টার আরও ১ কিলোমিটার। তবে সেখানকার কোনো স্থাপনাই ট্রেজারির মতো সুন্দর নয়। সিটি সেন্টারের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো, পেট্রা চার্চ, রাজপ্রাসাদ, বড় মন্দির ও নাট্যশালা। ইতিহাসে পেট্রা নগরী ও জর্ডান
গ্রিক শব্দ পেট্রস থেকে পেট্রা এসেছে। যার অর্থ পাথর। মিশরীয়রা সেলা নামে ডাকে। সেলা অর্থ শিলা। ওয়াদি রাম মরুভূমিতে পেত্রার অবস্থান। এখানকার বালি, পাহাড় আর পাথর দেখলে মনে হয়, এ যেন অন্য এক পৃথিবী। পাহাড়গুলোর উচ্চতা ৪০০ মিটারের মতো। আরবরা এগুলোকে বলে হিসমা। এখানে কিছু কিছু পাহাডের গায়ে সাড়ে তিন হাজার বছরের চিত্রকর্ম ও লিখিত বর্ণ পাওয়া গেছে। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যপথগুলোর মাঝে পেট্রা নগরীর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেট্রা ছিল প্রাচীন বাণিজ্যের হৃদপিণ্ড। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে উটের কাফেলা নিয়ে যেতো। হেজাজ, আরব ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই সব কাফেলা পরিচালনা করা হতো। যাত্রা বিরতিতে এই অঞ্চল ব্যবহার করতো। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যও হতো। আরব থেকে আসা চামড়া, ভারত ও চীন থেকে আসা মসলা, সিদ্ধ ও কাপড় এখানে লেনদেন করা হতো। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নয়, পেট্র নগরী অনুপম নির্মাণশৈলীর জন্যও বিখ্যাত ছিল।
নাবাতিয়ান জনগোষ্ঠীর বাসস্থান। নাবাতিয়ানদের রাজধানী। পাহাড় খোদাই করে প্রাসাদ, মন্দির ও সমাধিক্ষের গড়ে তুলেছিল তারা। এসব ছাড়াও রয়েছে নাট্যশালা। গবেষণার পরও এখানকার অনেক বিষয় এখনো রহস্য হয়ে আছে। একটি স্থান দিয়েই কেবল পেট্রা নগরে প্রবেশ করা যায়। এই প্রবেশ দ্বারের সব থেকে সরু অংশটি ২মিটার প্রশস্ত। এই সরু পথের জন্যই পেট্রা শহর ছিল দুর্ভেদ্য।
গাইড বলছিল, নাবাতিয়ানদের বংশধররা এখনো এখানে বসবাস করে। নাবাতিয়ানরা ইমেয়েন থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৬ শতকে প্রথম আরিতাস ছিলেন তাদের রাজা। চতুর্থ আরিতাস পর্যন্ত তাদের রাজ্য পরিচালনা করতো এখান থেকেই।
ভৌগলিক অবস্থানের জন্য পেট্রা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। এটিকে বলা হতো ইনসেন্স রোড। ইনসেন্স অর্থ ধূপ । এই পথে ধূপ, সুগন্ধি, জাফরান, গোলমরিচ, দারুচিনিসহ অনেক মসল্য পরিবহন করা হতো। তৎকালীন বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। তৎকালীন ধনী নাবাতিয়ানদের অবস্থা ছিল বর্তমান বিশ্বের ধনী আরব শেখদের মতো।
অনেক সময় পর্যন্ত নাবাতিয়ানরা দামেস্ক ও জেরুজালেম অবরোধ করে রেখেছিল। পরে এরা রোমান সাম্রাজ্যের কাছে নতি স্বীকার করে। রোমানদের ভূমি দাসে পরিণত হয়। এই নগর সভ্যতা কী করে বিলীন হয়েছিল, এই সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা পাওয়া যায় না। নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য ১০৬ সালের পর রোমানদের হাতে চলে যায়। কয়েকশ বছর পর আবার আসে ক্রুসেডারদের হাতে ও পরে মামলুক সুলতানদের হাতে। মনে করা হয়। দুই তিন বার ভূমিকম্পের পর ১৪ শতক থেকে ৫০০ বছরের জন্য ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় পেট্রা।
অনেকদিন পাথুরে এই দুর্গম পথের সন্ধান জানতো না সভ্য দুনিয়া। হাতেগোনা কিছু আরব বেদুঈন শুধু জানতো এ পথের সুলুকসন্ধান। সুইজারল্যান্ডের ট্রাভেলার জোহান লুডভিগ বার্কাডট ১৮১২ সালে এই নগরী পুনরায় আবিষ্কার করেন। এজন্য তাঁকে ছদ্মবেশ ও কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কারণ স্থানীয় বেদুঈনরা ইউরোপিয়ানদের বিশ্বাস করতো না। পাথরের ওপর পাশেই লুডভিসের জন্য অপেক্ষা করছিল অপার বিস্ময়।
বিস্ময় শুধু পেট্রা নয়, পুরো জর্ডানই আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। অথচ ১০০ বছর আগেও এই দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে ছিল না। তাই আর একটু ইতিহাসে উকি না দিলেই নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৌদিআরব, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, ইসরাইল দেশ ছিল না তখন। সব মিলিয়ে আরব ভূখণ্ড অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তুরস্কের অটোম্যানরা ১৯০৬ সালে একটি নতুন রেললাইন ও ট্রেন চালু করে। দামেস্ক থেকে তখনকার হেজাজ এলাকার (বর্তমান সৌদিআরব) মদিনা পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার রেলপথ হজযাত্রীদের ও সৈন্যদের চলাচলের জন্য। রেললাইন খোলার আগে একমাত্র বাহন ছিল উট। দামেস্ক থেকে লাইনটি বর্তমান জর্ডানের ওপর দিয়ে হেজাজের মদিনা পর্যন্ত যায়।
জর্ডান নদীর পূর্বতীরে এই আরব ভূমিকে বলা হতো ট্রান্সজর্ডান। জর্ডান নদীর পূর্ব তীর থেকে ইরাকের সীমান্ত পর্যন্ত এলাকাটি ছিল ট্রান্সজর্ডান। ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) পর্যন্ত সমস্ত আরব ভূখন্ডকে বলা হয় লেভান্ত।
ট্রান্সজর্ডান এলাকায় জনপদ ছিল রোক্ত যুগ থেকে। সময়কাল খিষ্টপূর্ব ৩২০০-১২০০ বাইবেলে বর্ণিত অনেক ঘটনা, স্থান ও নাম এই সময়ের মধ্যে পড়ে বলে মনে করা হয়। কিছু কিছু কোরআনে পাওয়া যায়। মোসেজ, আরন, অন দ্য ব্যাপ্টিস্ট, লোভ, জশুয়া ইসলামে যথাক্রমে নবী মুসা, হারুন, এহিয়া, লুত, ইহুয়া।
ট্রান্সজর্ডান এলাকায় তিনটি ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে। মোয়াব, আমন ও এডম। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে ইসরেল রাজা কিং ডেভিড এই রাজ্যগুলো দখল করে। তার পুত্র সলোমনের মৃত্যুর পর ইসরেল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর ট্রান্সজর্ডানে চলতে থাকে সাম্রাজ্য ও শাসকের পরিবর্তন। গ্রিক, নাবাতিয়ান, রোমান, দামেস্কের উমাইইয়া খেলাফত, বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফত, কায়রোর ফাতিমিদ খেলাফত। সবশেষে তুরস্কের অটোম্যান ট্রান্সজর্ডানসহ সমগ্র লেভান্ত এলাকা দখল করে প্রায় সাড়ে চারশ বছর তাদের শাসনে রাখে। আরব বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে অটোম্যান শাসনের পতন হয়। জন্ম হয় জর্ডানসহ কিছু আরব দেশের।
মণীরপাঁচেক কাটিয়েছি পেট্রা নগরে। মায় কয়েক ঘণ্টার পরিভ্রমণে এই নগরীর গুরুত্ব ও সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব নয়। অন্তত আমি পারি নি। বারবার মনে হচ্ছিল কী জানি ফেলে যাচ্ছি। হ্যাঁ তো, পেছনে রয়ে যাচ্ছে, রহস্য, ইতিহাস, কত না-জানা, অদেখা কিংবদন্তী। যেতে হবে পরের গন্তব্যে। সময়ের স্বল্পতা রয়েছে, কিন্তু স্বল্প সময়ে দেখতে চাই অনেক কিছু। এই নগরীর পথ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আবারও পেছন ঘুরে দেখে নিলাম ‘দ্য রেড রোজ সিটি’, হয়তো শেষবারের মতো।