বন্ধুত্ব হোক স্বার্থের ঊর্ধ্বে
ভারতের একাদশতম বাঙালি প্রথম মোসলমান রাষ্ট্রপতি ছিলেন এপিজে আব্দুল কালাম। তিনি বলেছেন, ‘একটা ভালো বই একশো জন বন্ধুর সমান, আর একজন ভালো বন্ধু একটা লাইব্রেরির সমান। তারও বহু আগে বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এরিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব৩৮৪-৭ই মার্চ, খ্রিষ্টপূর্ণ ৩২২) বলেছেন, ‘বন্ধু কী? এক আত্মার দুটি শরীর’। বিশ্বখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭-খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৮) বন্ধুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, ‘বন্ধুদের মধ্যে সব কিছুতেই একতা থাকে’।
বিশ্বখ্যাত মনীষীদের কথার জের ধরে বলতেই হয়, পৃথিবীতে বন্ধুত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু হয় না। বর্তমান যান্ত্রিকতার যুগে একজন ভালো বন্ধু মানসিক শান্তি দিতে সক্ষম। একাকিত্ব, বিষাদ, হতাশা কাটিয়ে জীবনচলার পথকে মসৃণ করতে সক্ষম। বন্ধু শব্দটি যতটা ছোট এর গভীরতা ততটাই বিশাল ও বিস্তৃত। বন্ধু থাকলে জগতের সব প্রতিবন্ধকতাকে সহজ ও সুন্দরভাবে পেয়িয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বন্ধুত্বটা হতে হবে প্রাণের। নিঃস্বার্থ নাহলে তাকে বন্ধুত্ব নামাঙ্কন করা যায় না। বরং বন্ধুত্বের গভীরতাকে হেয় করা হয়।
গ্রিক দর্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, ‘বন্ধুর শরীর আলাদা হলেও আত্মা এক। কারণ সমান মানসিকতার ব্যক্তির সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।’ কিন্তু আজকের এই স্বার্থবাদী দুনিয়ায় প্রকৃত বন্ধু পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। যার একজন ভালো বন্ধু আছে, পৃথিবীতে তিনি খুবই ভাগ্যবান। কারণ দিনশেষে এই বন্ধুর সঙ্গে হৃদয়ের সব বিষাদ, গ্লাপ্তি, হতাশা, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে মানুষ কতটা একা তা সমাজের বিশৃঙ্খলা দেখলেই অনুমান করা যায়। তাই বর্তমান যুগে ‘হ্যাপি ফ্রেন্ডস ডে’-এর গুরুত্ব অনেক। মানুষকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শেখাবে বেঁচে থাকতে বন্ধুর গুরুত্ব কতটা।
সুস্থ মন ও সুস্থ দেহের জন্য একজন ভালো বন্ধু অবশ্যম্ভাবী। কারণ একজন বন্ধুর সঙ্গে যখন মনের সব আনন্দ-হাসি-কান্না ভাগাভাগি করে নেওয়া তখন শরীর ও মন দুটোই সুস্থ থাকে। জীবনের সবটা একে অন্যের সঙ্গে কেড়ে ফেলে নতুনভাবে পথ চলা শুরু করা যায়। দিনশেষে এই জায়গাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জন্য। এই দিনটির তাৎপর্য তাই বলে শেষ করার মতো নয়। বন্ধু আছেন কিন্তু তার স্বীকৃতি স্বরূপ একটি দিনকে ধার্য করা হয়েছে। যদিও বন্ধুত্ব দিন, মাস, ক্ষণ, বছরের উর্ধ্বে। ভালো বন্ধু সুখে-দুঃখে কখনোই হাত ছাড়ে না। বরং এক বন্ধুর কষ্ট হলে সে কষ্ট অন্যকেও সমান প্রভাবিত করে! কিন্তু সত্যিই আজকের যুগে এমন বন্ধু পাওয়া দুরূহা তাই যারা এই ভাগ্যের অধিকারী তারা বিশেষভাবে বন্ধুকে আগলে রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। সেই আগলে রাখার, স্বীকৃতি স্বীকার করার অন্যতম দিন বন্ধু দিবস।
কিছু সম্পর্ক রক্তের না-আত্মার। তেমনি এক সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, বিত্ত, স্থান, কাল, লিঙ্গভেদ দ্বারা পৃথক করা যায় না। সবক্ষেত্রেই বন্ধুর অবস্থান আত্মায়। একজন প্রকৃত বন্ধু সব সময়ের জন্যই বন্ধু। বিপদ- আপদ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব কিছুতেই বন্ধুর অংশ গ্রহণ সর্বাগ্রে। একজন ভালো বন্ধু যেমন জীবনের গতিপথে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে ঠিক তেমনই একজন ভণ্ড বন্ধুর খররে পড়লে জীবনের অপরিমেয় ক্ষতিসাধন হওয়া অসম্ভব নয়। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকা খুবই প্রয়োজন।
আমরা জানি, পৃথিবীতে ভালো বই ও বন্ধু খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। বন্ধুরা জীবনের এমন একটা অংশ যার সঠিক কোনো ব্যাখ্যাও নেই। প্রকৃতার্থে কোনো রকম বিচার-বিবেচনা ছাড়াই মন খুলে কথা বলতে পারার বিশেষ মানুষই হলো আপনার বন্ধু। বন্ধুত্ব উদযাপনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে একটি বিশেষ দিন তাই ধার্য করা হয়েছে। মনে পড়ে বিখ্যাত সেই গানা ‘পুরো পৃথিবী একদিকে, আর আমি অন্য দিক/ সবাই বলে করছ ভুল, আর তোরা বলিস ঠিক/ তোরা ছিলি, তোরা আছিস/ জানি তোরাই থাকবি/ বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কী লাগে? শিল্পী তপুর গাওয়া এই গানটা। ঠিক তাই। ভালো বন্ধু থাকলে আর কিচ্ছু লাগে না। বন্ধুর হাত ধরে বক্র পথও সহজ হয়া
বন্ধু দিবস ঘোষণার উৎপত্তি বা কারণ ঠিক কী, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতা মানুষের মধ্যে অনেকটাই বন্ধুর অভাব তৈরি করেছিল বলে অনেকের অভিমত। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধু দিবস পালন করার ধারণা এসেছিল বলে অনেকে মনে করেন।
তবে এই বন্ধু দিবসটা কিভাবে এলো। সে সম্পর্কেও অনেকের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। এক সূত্র অনুযায়ী, বন্ধু দিবসের
শুরু হয়েছিল অনেক আগে। ১৯১৯ সালে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কার্ড, ফুল, উপহার বিনিময় করতো। ১৯১০ সালে জয়েস হলের প্রতিষ্ঠিত হলমার্ক কার্ড বন্ধু দিবস পালনের রীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিল।
আবার জানা যায়, ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হতর করেছিল। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরদিন ওই বাক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে জীবনের নানাক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকেই বন্ধুত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়। শিগগিরই এটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে রূপ লাভ করে।
১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই, ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড (World Friendship Crusade) এর প্রতিষ্ঠাতা ‘Dr. Ramlin Artemio Bracho বন্ধুদের সঙ্গে প্যারাগুয়ের পুয়ের্তো পিনাসকোতে (নদীর তীরে একটি শহর যা উত্তর Asuncion, Paraguay থেকে প্রায় ২০০ মাইল দূরে অবস্থিত) এক নৈশভোজে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে রাতেই এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা পায় এবং ৩০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠায়। প্রায় ৫৩ বছর পর, ২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস পালিত হয়। তবে ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগস্ট মাসের প্রথম রণিধার বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে চিহ্নিত।
বন্ধু দিবস বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে পালন করা হয়। তবে এখনো বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্টের
প্রথম রোববারই বন্ধু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আবার কোনো কোনো দেশে ৮ এপ্রিল বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সংস্কৃতির মধ্যে বন্ধুত্ব শান্তিকে সুনিশ্চিত করে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জাতির মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটাতেও এই দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক বস্তুত্ব দিবসের সূচনা করা হয়।
প্রথম প্রেমের গল্প, মন ভাঙার গল্প, পরীক্ষায় মনঃপুত রেজাল্ট না করা, অভিভাবকদের শাসন-শোষণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নানাবিধ বিষয় বস্তুর সঙ্গেই শেয়ার করে মানুষ। এমনকি মন খারাপ হলে রাতে গল্প করার জন্যও বন্ধুর কাছে আবদার করা হয়। হুটহাট ঘুরতে যাওয়া, লং ড্রাইভ, নানারকম অ্যাডভেঞ্চার সবেতেই মানুষ বন্ধুকে পাশে চায়। বন্ধুর সঙ্গে যাপন করে আনন্দ পায়।
বর্তমান সময় মানব জীবন খুবই অস্থিতিশীল। যুগের টানাপড়েনে মানুষ যতটা সমৃদ্ধ হতে চাচ্ছে, ঠিক ততটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির যুগে মানুষ ক্রমাগত ফোনের মধ্যে ডুবে থাকো আগের যুগের মানুষ যেভাবে আত্মিকভায় অন্যকে আপন করে নিতো এখনকার মানুষ ঠিক তার উল্টো। বরং প্রযুক্তির বদৌলতে মানুষও কাটখোট্টা হয়ে যাচ্ছে। দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করার মানুষ নেই, নির্মল আনন্দ পাওয়ার উপায় নেই। ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা-স্বপ্নভঙ্গ বাড়ছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষ প্রকৃত বন্ধুর অভাবে নিঃসঙ্গ ও একাকীত্বের ভার এতটাই বোঝা মনে হচ্ছে একসময় আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হচ্ছেন ন্যা তাই মানবজীবনকে মসৃণ রাখতে ভালো বন্ধুর বিকল্প নেই। বন্ধু হোক সুখ-দুঃখের সঙ্গী।
সাইরাস বলেছেন, আস্থাই বন্ধুত্বের একমাত্র বন্ধনসূত্র। তাই বন্ধুত্বের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। এমন বন্ধু কখনোই কারও কাম্য নয়, যে বন্ধু পিছন থেকে ছুরি মারতে পারে। বন্ধুত্বের মহত্তম আত্মিকতাকে হিংস্র করলে সেখানে বন্ধুত্ব থাকে না। ভক্সমির সম্পর্ক কখনোই বন্ধুত্ব হতে পারে না। মানুষের বেঁচে থাকার পথে বন্ধুত্ব চির অমর। একজন ভালো বন্ধু থাকলে ব্যক্তির কখনোই মন খারাপ হতে পারে না। কারণ যদি মন খারাপ হয় তবে বন্ধু সেখান থেকে নিশ্চিত বের করে আনবেন। এটাই বন্ধুর পরিচয়।
পণ্ডিত চাণক্য বলেছিলেন, ‘যে বন্ধু সুসময়ে ভাগ বসায় আর দুঃসময়ে ত্যাগ করে চলে যায়, সেই বন্ধুই, তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু। ঠিক তাই। বন্ধু কখনো দুঃসময়ে ছেড়ে যেতে পারেন না। যে যায় সে বন্ধু নয়। বরং এমন শত্রুর থেকে সাবধান হওয়া জরুরি। বন্ধু হচ্ছে আয়নার মতো। তার কাছে সবটা খোলাস্য থাকে। ফলে মনের এমন কোনো খারাপ লাগা, ভালো লাগা তার কাছে বলতে হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয় না। বরং সেখান থেকে মানসিক শান্তি আসে।
বন্ধুত্বের জয় হোক। বন্ধুত্বের অমলিন সম্পর্কে মানুষ তার জীবনকে উপভোগ করতে শিখুক। বন্ধু তো সেই যার কাছে স্বস্তির নিঃশ্বাস পাওয়া যায়। ভয়কে জয় করার সাহস পাওয়া যায়। বন্ধু তো সেই যে গাছের মতো ঝড়-বৃষ্টি সহ্য করে বন্ধুকে আগলে রাখে। বন্ধু দিবসে প্রকৃত বন্ধুদের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘যদি থাকে বন্ধুর মন গাং পার হইতে কতক্ষণ।’ তাই বন্ধুর হাত ধরে জীবনচলার পথের জটিল-কঠিন অসাধ্যকেও সাধন করার সক্ষমতা তৈরি হোক প্রত্যেকের।