স্বামী-স্ত্রীর আলাদা থাকার প্রবণতা বাড়ছে কেন?
আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে এখন প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মানুষ কেউই বের হতে পারছে না। তাই মানবজীবনে ব্যাপকহারে এর প্রভাব পড়ছে। ব্যক্তিজীবনে সেই প্রভাব এতটাই বেশি যে, পারিবারিক সম্পর্কগুলোও শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে নানা পরিবর্তন ও সংকট দেখা দিচ্ছে। একটা সময় এই উপমহাদেশে যৌথ পরিবার প্রথা প্রচলিত থাকলেও আজ হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ যারা এমন জীবনযাপন করে। তেমনই আজ একক পরিবারেও ভাঙন ধরেছে। কোথাও বা পরিবর্তন এসেছে। জীবনের তাগিদেই এমন পরিবর্তন ঘটছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা থাকার প্রবণতা বাড়ছে। সে সামাজিক, রাষ্ট্রিক, আর্থিক সব পরিবর্তনের ফলেই বলে চলে। মানসিক পরিবর্তনও এর মধ্যে ব্যাপক ক্রিয়াশীল। মানুষ আর আগের মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকে না, সে নারী বা পুরুষ হোক। জীবনের তাগিদে, পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই উপার্জনমুখী হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুজনের একই স্থানে অনেক সময় থাকা
সম্ভব হয়ে উঠছে না। ফলে দুজনকে বেছে নিতে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন জীবন। আমরা জানি, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক সম্পর্কের মাধ্যমে গড়ে ওঠে বিশ্বাস ও আস্থা। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজে দুজনেরই কর্মক্ষেত্রে অবদানের কারণে তৈরি হয়েছে আলাদা থাকার প্রবণতা।
গবেষণায় দেখা যায়, স্বামীর কর্মসংস্থান কিংবা শিক্ষার কারণেও স্ত্রী দূরে থাকছে। আবার অভিবাসনকেও দায়ী করেন অনেক নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী। ফলে এক জরিপে দেখা গেছে দেশের ১৬ শতাংশ নারীকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করতে হচ্ছে বর্তমানে। যা কোনোভাবেই হেলাফেলার বিষয় নয়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মাধ্যমে জানা যায়, নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী ২ পক্ষেরই সমান ভূমিকা রয়েছে। এখানে এক পক্ষের শারীরিক অনুপস্থিতি আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সন্তানের শিক্ষা, নৈতিকতা ও সম্মানবোধ।
স্বামী থেকে আলাদা বসবাস করা নারীদের তথ্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) সর্বশেষ জরিপে। এর নাম ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (২০২২)’। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিবাহিত নারীদের ১৬ শতাংশ স্বামী থেকে পৃথক থাকছেন। সবচেয়ে বেশি আলাদা থাকতে হয় গ্রামাঞ্চলের নারীদের। তাদের মধ্যে এ হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। শহরে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ।
জরিপে আরও দেখা গেছে, স্বামী থেকে পৃথক থাকার হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে। এ বিভাগের প্রায় ২৮ শতাংশ নারী স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকেন। এ ছাড়া বরিশালে ২০ শতাংশ, সিলোটে ১৮, ঢাকায় ১৫, ময়মনসিংহে ১৩, খুলনায় ১২, রাজশাহীতে ১০ ও রংপুর বিভাগে ৯ শতাংশ জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ বিবাহিত নারী জানান, তাদের স্বামীরা (জরিপকাল থেকে) গত এক বছরের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে একবারও সাক্ষাৎ করেননি।
এই হার শহরে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ। গ্রামে ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। ৪১ শতাংশ নারীর স্বামী বছরে এক থেকে পাঁচবার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বছরে ছয় থেকে ১১ বার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতে এসেছেন ১১ শতাংশ স্বামী। আর প্রতি মাসে এক বা একাধিকবার পরিবারের সাক্ষাৎ পেয়েছেন ১১ শতাংশ স্বামী। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান এ শাফী জানান, পরিবারে স্ত্রী ও স্বামীর ভূমিকার সমন্বয় খুবই জরুরি। বাবার কাছ থেকে নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা থেকে শিশুরা বঞ্চিত হয়। বয়ঃসন্ধিকালে বাবাকে না পেলে সহিংসতা ও মাদক গ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিবার একটি সামাজিক কাঠামোর একক। যখন একটি পরিবার সঠিকভাবে গড়ে ওঠে না, তখন ওই পরিবার সমাজের অন্যান্য পরিবারের সঙ্গেও যুক্ত হতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী জানান, সমাজ বদলে যাওয়ায় নারী-পুরুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ সংকট মোকাবিলায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
স্বামী-স্ত্রীর আলাদা থাকার প্রবণতা যদি কারণে-অকারণে বাড়তেই থাকে তবে পারিবারিক মূল্যবোধ ও সম্পর্কের দৃঢ়তা কমে আসবে। এবং সন্তানদের মধ্যে হতাশা-বিছিন্নতা-বিষাদের জন্ম হবে। যা আজকাল অহরহ দেখা মিলছে। এ থেকে বের হয়ে আসতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। চাকরি হলে বদলির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য হলে সীমানার মধ্যে থেকেই করার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয় বা পরিবারকে সঙ্গে রাখার প্রবণতা গড়ে তুলতে হবে। যদিও পরিবারকে সবসময়। কাছে রাখার মতো অর্থনৈতিক যোগানও সবার থাকে না। তবু সাধ্যের মধ্যে সুখের স্বস্তির জায়গা তৈরি করতে হবে। পারবারিক সম্পর্ক দৃঢ় হোক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দৃঢ় হোক ও দূর হোক আলাদা থাকার প্রবণতা।