Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মে দিবস যেভাবে এলো

হাদিসে আছে, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার মজুরি দিয়ে দাও” কিন্তু যুগে যুগে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা নিতান্ত অবহেলা অপমানের শিকার হয়ে আসছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং সে অনুযায়ী মজুরি না পাবার ঘটনা, এর সাথে বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার, শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের সাথে এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে এমন একটা দিন আছে, যে দিনে দুনিয়ার সব শ্রমিক এক হয়ে যায়, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে পয়লা মে একসময় প্রিয় ফুল খেলবার দিন’ বলেই পরিচিত ছিল। উত্তর গোলার্ধের মানুষেরা মে দিবসের প্রথম দিনটিতে বসন্ত বরণ উৎসবে মেতে উঠত। রিক্ত শূন্য শীতের অবসান ঘুচিয়ে তা ছিল উষ্ণতার উৎসব। বিশেষত, শ্রমজীবী মানুষদের কাছে বসন্তের আগমন ছিল বিশেষ কিছু। কিন্তু বছরের পর বছর অবর্ণনীয় শ্রম-শোষণে নিষ্পেষিত শ্রমজীবী মানুষ ফুল খেলবার দিনটিতেই পথে নেমেছিল, ফুঁসে উঠেছিল সম্মিলিতভাবে।

তবে এখন, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১ মে পালিত হয় বিশ্ব শ্রমিক দিবস। কেননা, বসন্তের আগমনের চেয়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য যে রক্ত দিতে হয়েছে, পৃথিবী সেটা ভুলে যেতে চায়নি।

কল্পনা করুন, একজন শ্রমিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করছেন। বিরতিহীন। পারিশ্রমিকও খুবই নগণ্য। আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে আমেরিকান সমাজে এ-ই ছিল নিয়ম। এই নির্মম জুলুম আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে আমেরিকার শ্রমিকেরা ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানায়। এ দাবি পূরণের সময় হিসেবে ১৮৮৬
সালের ১ মে-কে নির্ধারণ করেন শ্রমিকরা। কিন্তু কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে তোলেননি। ফলাফলে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে ফের আন্দোলন গড়ে তোলেন শ্রমিকরা।

এসময় হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিক পক্ষে বক্তব্য রাখেন আমেরিকান লেবার অ্যাক্টিভিস্ট অগাস্ট স্পিস। উদ্বেলিত শ্রমিকদলের কিছু দূরেই ছিলো পুলিশ। এসময় সবার অলক্ষ্যে হঠাৎ পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ হলে নিহত হন একজন পুলিশ কর্মকর্তী। তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে, পুলিশের গুলিতে নিহত হন প্রায় ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক। পুলিশের ওপর কে বা কারা বোমা হামলা করেছিলো তা সঠিক জানা না গেলেও, পুলিশ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ও আটক করা হয় অগাস্ট স্পিসসহ আরও আটজনকে। পরের বছর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর অগাস্ট স্পিসসহ অভিযুক্ত ছ’জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি দুজনের একজন কারাবন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করেন ও অন্য একজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।

এ ঘটনার দু’বছর পর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের একশো বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে, শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে উদযাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড গাভিনে। এই হল আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের সূচনা।

১৮৯১ সালে প্যারিসেই আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। স্বীকৃতি পায় মে দিবস।

১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ের জন্য এবং শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল গণতান্ত্রিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে সব শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন, কিউবা-সহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সে সব দেশে এই উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়।

১৯২৩ সালে লেবার পার্টি অব হিন্দুস্তান ভারতে এই দিনটি পাষন করার সিদ্ধান্ত নেয়। চেন্নাইয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের লাল পতাকা তোলা হয়।

বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই বেশি। শ্রমিক দিবসের প্রেরণা থেকে বাংলাদেশ মোটেও পিছিয়ে নেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। ঐ বছর সমা স্বাধীন দেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। তারপর থেকে আজও পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন বহাল আছে। এদিন শ্রমিকরা মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করে মে দিবস। তারা তাদের পূর্বসূরীদের স্মরণে আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসে আয়োজন করে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচীর। বাংলাদেশের শ্রমিকরা এদিন তাদের নিয়মিত কাজ থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেয়ে থাকে। আনন্দঘন পরিবেশে তারা উদযাপন করে মহান মে দিবস।
৮০-র বেশি দেশে এই দিনটি পালিত হয়। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হিসাবে চিহ্নিত।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ