Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সেই বৈশাখ, এই বৈশাখ

বৈশাখ মানেই বাঙালি। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি মানেইপহেলা বৈশাখ। একথা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারব না।

আমরা অস্বীকার করতে পারবনা যে বৈশাখ মানেই একরাশ হতাশা আর ব্যর্থতার পাহাড় ডিঙিয়ে প্রাণের উচ্ছাসে বাঙালির ভেসে যাওয়া। তাই তো গ্রাম থেকে শহর-প্রান্তরের প্রতিটি আনাচে-কানাচে বৈশাখের আগমনে প্রাণের জোয়ার জাগে বাঙালির জীবনে।

শহর কিংবা গ্রাম যে কোন পটভূমিতে আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে ভিন্নমাত্রিক আঙ্গিকতা পরিলক্ষিত হলেও প্রাণের উন্মাদনা সবার জন্য এক। দিন বদনের সাথে সাথে আধুনিকতার ধরে অনেক পরিবর্তন এসেছে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে। তবে শহরে সভ্যতার বর্ণিল ছোঁয়া তেমন করে গ্রাস করে নিতে পারেনি গ্রামীণ আটপৌরে জীবনের বৈশাখি আয়োজনকে। আজও আমাদের গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় বিশ/তিরিশ বছর আগেকার পুরাতন গতিময়তায়।

যেভাবেই পালিত হোক না কেন, আমাদের প্রাণের উচ্ছ্বাস আর হৃদয়ের ঝরনাধারায় বর্ণিল পয়লা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ শুরুর ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেয়া দরকার বলে মনে করছি এ প্রসংগে। জানা যায় যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুসারিত পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা নববর্ষ শুরু হয় মধ্য এপ্রিলে। সে হিসেবে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ বা ১লা বৈশাখ পালন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বা বঙ্গাব্দ এর উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মতভেদ রয়েছে। কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে, এই উপমহাদেশে তৃতীয় মোগল সম্রাট জালালউদ্দীন মুহাম্মদ আকবর প্রথম এই উপমহাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেন এবং এটিই ঐতিহাসিকভাবে গৃহীত মতভেদ। এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের নিকট থেকে কর সংগ্রহকে সহজতর করা। এর আগে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে কর সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু হিজরী বছরের শুরু বা শেষ যখন হতো তখন তার আগেই শস্য মাড়াই এর কাজ সম্পন্ন হয়ে যেত। ফলে অনেক কৃষকের পক্ষে কর পরিশোধ করা সম্ভব হতো না।

সম্রাট আকবরের রাজদরবারের জোতিষী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী নানারকম গবেষণা করে যে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন সেটা চালু হয় ১৫৮৪ বঙ্গাব্দে। এই বর্ষপঞ্জির নাম ছিল ফসলি সান। তখন ইংরেজি সন ছিল ১৫৫৬ এবং হিজরী সন ছিল ৯৬৩। এই দিনটি আরও একটি কারণে বিখ্যাত। ঐদিন সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করেন। সেই আনন্দে তিনি সামনের চৈত্র মাস পর্যন্ত কৃষকদের সমস্ত বকেয়া কর মাফ করে দেন। এরপর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে বছরভিত্তিক করের হিসাব চালু করেন। সেই দিন থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তখন পহেলা বৈশাখের দিনে ভূমি মালিকগণ কৃষকদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করতেন, ব্যবসায়ীরা হালখাতা করে পুরানো বছরের দেনা- পাওনার হিসাব ঢুকিয়ে নতুন বছরের জন্য নতুন হিসাব শুরু করতেন। তখনও এই দিনটি উদযাপন করা হতো দিনব্যাপী মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

তবে বর্তমানে বাংলা বছর যে ১২টি মাস নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে বঙ্গাব্দের সূচনালগ্নে এই ১২টি মাস কিন্তু এই নামে পরিচিত ছিলনা। তখন ১২টি বাংলা মাসের নাম ছিল যথাক্রমে কারভাঙিন, আরডি, ভিহিসু, খোরদাদ, তীর, আমারদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আমুর, ডাল, বাহাম ও ইসকানদর। কিন্তু বর্তমানে বাংলা মাসগুলো যে নামে পরিচিত সে নামগুলো কখন কিভাবে শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, এই মাসগুলোর নাম সৌরজগতের জ্যোতিষ্ক মন্ডলীর নাম অনুসারে করা হয়েছে। যেমন ১. বৈশাখ এসেছে বিশাখা থেকে, ২. জৈষ্ঠ্য এসেছে জাইয়্যা থেকে, ৩. আষাঢ় এসেছে যাঢ় থেকে, ৪. শ্রাবণ এসেছে শ্রাবণী থেকে, ৫. ভাদ্র এসেছে ভাদ্রপদ্য থেকে, ৬. আশ্বিন এসেছে আশআনি থেকে, ৭. কার্তিক এসেছে কার্তিকা থেকে, ৮. অগ্রহায়ণ এসেছে আগ্রাইহন থেকে, ৯. পৌষ এসেছে পৌষিয়া থেকে, ১০. মাঘ এসেছে মাথা থেকে, ১১. ফাল্গুন এসেছে ফাল্গুনি থেকে ও এবং ১২ চৈত্র এসেছে চিত্রা থেকে। রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরগুলোতে প্রতি বছর নানা বর্ণিল আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। প্রাণের টানে বয়সের পিছুটানকে উপেক্ষা করে প্রতি বছর চেষ্টা করি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু ছোটবেলায় আব্বার হাত ধরে বটতলায় বা নদীর তীরের বৈশাখি মেলায় যাবার স্মৃতি কিছুতেই ভুলবার নয়। ঢাকায় বৈশাখ উদযাপনের সব বর্ণানে আয়োজন যেন এর কাছে জ্ঞান হয়ে যায়। তাই বৈশাখের আগমন মুহূর্তে আমার ভিতর স্মৃতির পাপড়িরা ডানা মেলতে শুরু করে। ভুলতে পারিনা চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন থেকে মা-চাচী-দামীদের ব্যস্ততার কথা। বৈশাখকে ঘিরে তখনকার আটপৌরে গ্রামীণ জীবনের ভিতর বাড়ির দৃশ্য ছিল এমনি। মা-চাচীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন চৈত্র সংক্রান্তির দিন আর পহেলা বৈশাখের দিনের খাবার আয়োজন নিয়ে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে সব ধরনের শাক খাওয়ার রীতিটা ছিল বহুদিনের প্রচলিত প্রথা। বিগত বছরের সমস্ত জরা-ব্যাধি দূর হয়ে যাবে-এই বিশ্বাসে প্রচলিত-অপ্রচিত সব ধরনের শাকের সমাহার ঘটত চৈত্র সংক্রান্তির দিনের দুপুরের খাবারে। তার সাথে চলত ঘর- বাড়ি ঝাড়-মোছের কাজ। বিদায়ী বছরের সমস্ত ধুলো-বালি- ময়লা-আবর্জনা দূর করে ঝকঝকে-তকতকে করে তোলা হতো বাড়িঘর। যাতে বৈশাখের আগমন ঘটে সূচী-শুভ- পবিত্রতার মধ্য দিয়ে।

মা-চাচীদের এই ধরনের আয়োজন আমাদের অর্থাৎ ছোটদের মনে বৈশাখকে ঘিরে বাড়তি উদ্দীপনা জাগিয়ে দিত। পরের দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। জমবে বৈশাখি মেলা। এর আগাম আনন্দবার্তা নিয়ে আসত চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি। সারারাত উদ্দীপনায় আমাদের ঘুম হতোনা। যেমনটি হতো চাঁদ রাতের বেলায়। অপেক্ষায় থাকতাম কখন রাত পোহাবে। বৈশাখি মেলায় যাব। হাতি-ঘোড়া-পুতুল কিনব। সবচেয়ে মজা পেতাম খাওয়ার হাতি-ঘোড়া কিনতে পেরে। আমাদের দেশে। এগুলোকে বলে সাজি। সাজি কিনতে না পারলে মনে হতো মেলায় যাওয়াটাই বৃথা গেল। সাথে কিনতাম বিন্নি ধানের খৈ। আর কিনতাম মাটি দিয়ে বানানো রং বেরং এর পুতুল, বাঁশী, আরও নানা ধরনের খেলনা। মা-চাটীদের এই ধরনের আয়োজন আমাদের অর্থাৎ ছোটদের মনে বৈশাখকে ঘিরে বাড়তি উদ্দীপনা জাগিয়ে দিত। পরের দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। জমবে বৈশাখি মেলা। এর আগাম আনন্দবার্তা নিয়ে আসত চৈত্রসংক্রান্তির দিনটি। সারারাত উদ্দীপনায় আমাদের ঘুম হতোনা। যেমনটি হতো চাঁদ রাতের বেলায়। অপেক্ষায় থাকতাম কখন রাত পোহাবে। বৈশাখি মেলায় যাব। হাতি-ঘোড়া-পুতুল কিনব। সবচেয়ে মজা পেতাম খাওয়ার হাতি-ঘোড়া কিনতে পেরে। আমাদের দেশে এগুলোকে বলে সাজি। সাজি কিনতে না পারলে মনে হতো মেলায় যাওয়াটাই বৃথা গেল। সাথে কিনতাম বিন্নি ধানের খৈ। আর কিনতাম মাটি দিয়ে বানানো রং বেরং এর পুতুল, বাঁশি, আরও নানা ধরনের খেননা।

বৈশাখের সকাল বেলাতেই রান্নাঘরে দেখতাম আম্মার অন্যরকম ব্যস্ততা। নানা রকম পিঠে দিয়ে নাস্তা হবে। এখনকার মতো সকালবেলা পান্তা ইলিশ দিয়ে নাস্তা খাওয়ার রীতি গ্রামে তখনও ছিলনা, এখনও নেই। নাস্তার পর দুপুরের খাবারের আয়োজনে লেগে যেতেন আম্মা। কারণ, পহেলা বৈশাখের দিনের দুপুরের খাবার অন্যদিনের মতো গতানুগতিক হলে চলত না। সাধ্যমতো বছরের প্রথম দিনটিতে ভালো ভালো খাবারের আয়োজন চলত ঘরে ঘরে। বিশ্বাস এই যে, পহেলা বৈশাখের দিন ভালো খাবার খেলে সারা বছর এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অভাব আর দারিদ্রের নিষ্পেষণে জর্জড়িত গ্রাম বাংলার মানুষের এই বিশ্বাস কতটুকু ফলপ্রসূ হতো তা আজও জানার অতীত। তবে আজও গ্রামের মানুষ এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছে বৈশাখি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। আজকাল যেমন শহরে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন কাপড় পড়ার প্রচলন দেখতে পাই তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে তো বটেই শহরেও এমনটি ছিলনা। আমাদের গ্রামাঞ্চলের সেই আবহ এখনও বজায় থাকলেও পাল্টেগেছে শহুরে আনুষ্ঠানিকতা। আমরাও কখনও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন পোশাকের জন্য বায়না ধরতাম না। আব্বা আমাদের চাহিদামতো সব ধরনের খেননাপাতি ও খাবার জিনিস কিনে দিতেন। তাই নিয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতাম আমরা। বাড়ি আসার পথে সেই কি দুশ্যা চোখের পর্দায় এখনও লেগে আছে যেন। মেলাফেরত মানুষের মিছিল। সব বাচ্চাদের হাত ভর্তি জিনিসপত্র। বাঁশীর প্যাঁ পোঁ শব্দে মুখর হয়ে উঠত চারপাশ। বাড়ি ফিরেই বসে পড়তাম কার কোন খেলনাটা কত সুন্দর হয়েছে সেটা ঠিক করতে।

আজ বহুদূর ফেলে এসেছি সেই পহেলা বৈশাখের দিনগুলো। আমার মা-বাবা কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু মহাকালের চিরায়ত নিয়মে আজও বৈশাখ আসে। নববর্ষের উদ্দীপনায় মেতে উঠি আমরা। শহরের কোলাহলমুখর ব্যস্ততায় আমার মা-চাচীদের আটপৌরে আয়োজনে উদযাপিত পহেলা বৈশাখের দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না সেই বটতলার কথা, নদী তীরের কথা। আমার কানে আজও বাজে সেই বাঁশীর সুর। বৈশাখি মেলা থেকে কিনে যে বাঁশীর সুরে চারদিক মাতিয়ে তুলতাম আমরা। আজ মনে হয় আমার প্রাণের নির্মল উচ্ছ্বাসটুকু জড়িয়ে আছে বাঁশীর সেই সুরের সাথে। তাই বৈশাখের আগমন মুহূর্তে ছোটবেলার কথা স্মরণ করে বুকের ভিতর অন্যরকম ভালো লাগার অনুভবে আজও আলোড়িত হই আমি। আমার বুকের ওমে পরম আদরে পুষে রাখা সুখের ছোট্ট সুখপাখী এটি। আমৃত্যু আমার মনে সুখের সরোবর হয়ে বেঁচে থাকবে।সেই বৈশাখ, এই বৈশাখ।

বৈশাখ মানেই বাঙালি। বাঙালির চিরায়তচিরায়ত সংস্কৃতি মানেইপহেলা বৈশাখ। একথা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারব না। আমরা অস্বীকার করতে পারবনা যে বৈশাখ মানেই একরাশ হতাশা আর ব্যর্থতার পাহাড় ডিঙিয়ে প্রাণের উচ্ছাসে বাঙালির ভেসে যাওয়া। তাই তো গ্রাম থেকে শহর-প্রান্তরের প্রতিটি আনাচে-কানাচে বৈশাখের আগমনে প্রাণের জোয়ার জাগে বাঙালির জীবনে।

শহর কিংবা গ্রাম যে কোন পটভূমিতে আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে ভিন্নমাত্রিক আঙ্গিকতা পরিলক্ষিত হলেও প্রাণের উন্মাদনা সবার জন্য এক। দিন বদনের সাথে সাথে আধুনিকতার ধরে অনেক পরিবর্তন এসেছে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে। তবে শহরে সভ্যতার বর্ণিল ছোঁয়া তেমন করে গ্রাস করে নিতে পারেনি গ্রামীণ আটপৌরে জীবনের বৈশাখি আয়োজনকে। আজও আমাদের গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় বিশ/তিরিশ বছর আগেকার পুরাতন গতিময়তায়।

যেভাবেই পালিত হোক না কেন, আমাদের প্রাণের উচ্ছ্বাস আর হৃদয়ের ঝরনাধারায় বর্ণিল পয়লা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ শুরুর ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেয়া দরকার বলে মনে করছি এ প্রসংগে। জানা যায় যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুসারিত পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা নববর্ষ শুরু হয় মধ্য এপ্রিলে। সে হিসেবে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ বা ১লা বৈশাখ পালন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বা বঙ্গাব্দ এর উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মতভেদ রয়েছে। কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে, এই উপমহাদেশে তৃতীয় মোগল সম্রাট জালালউদ্দীন মুহাম্মদ আকবর প্রথম এই উপমহাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেন এবং এটিই ঐতিহাসিকভাবে গৃহীত মতভেদ। এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের নিকট থেকে কর সংগ্রহকে সহজতর করা। এর আগে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে কর সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু হিজরী বছরের শুরু বা শেষ যখন হতো তখন তার আগেই শস্য মাড়াই এর কাজ সম্পন্ন হয়ে যেত। ফলে অনেক কৃষকের পক্ষে কর পরিশোধ করা সম্ভব হতনা।

সম্রাট আকবরের রাজদরবারের জোতিষী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী নানারকম গবেষণা করে যে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন সেটা চালু হয় ১৫৮৪ বঙ্গাব্দে। এই বর্ষপঞ্জির নাম ছিল ফসলি সান। তখন ইংরেজি সন ছিল ১৫৫৬ এবং হিজরী সন ছিল ৯৬৩। এই দিনটি আরও একটি কারণে বিখ্যাত। ঐদিন সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করেন। সেই আনন্দে তিনি সামনের চৈত্র মাস পর্যন্ত কৃষকদের সমস্ত বকেয়া কর মাফ করে দেন। এরপর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে বছরভিত্তিক করের হিসাব চালু করেন। সেই দিন থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তখন পহেলা বৈশাখের দিনে ভূমি মালিকগণ কৃষকদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করতেন, ব্যবসায়ীরা হালখাতা করে পুরানো বছরের দেনা- পাওনার হিসাব ঢুকিয়ে নতুন বছরের জন্য নতুন হিসাব শুরু করতেন। তখনও এই দিনটি উদযাপন করা হতো দিনব্যাপী মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

তবে বর্তমানে বাংলা বছর যে ১২টি মাস নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে বঙ্গাব্দের সূচনালগ্নে এই ১২টি মাস কিন্তু এই নামে পরিচিত ছিলনা। তখন ১২টি বাংলা মাসের নাম ছিল যথাক্রমে কারভাঙিন, আরডি, ভিহিসু, খোরদাদ, তীর, আমারদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আমুর, ডাল, বাহাম ও ইসকানদর। কিন্তু বর্তমানে বাংলা মাসগুলো যে নামে পরিচিত সে নামগুলো কখন কিভাবে শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, এই মাসগুলোর নাম সৌরজগতের জ্যোতিষ্ক মন্ডলীর নাম অনুসারে করা হয়েছে। যেমন ১. বৈশাখ এসেছে বিশাখা থেকে, ২. জৈষ্ঠ্য এসেছে জাইয়্যা থেকে, ৩. আষাঢ় এসেছে যাঢ় থেকে, ৪. শ্রাবণ এসেছে শ্রাবণী থেকে, ৫. ভাদ্র এসেছে ভাদ্রপদ্য থেকে, ৬. আশ্বিন এসেছে আশআনি থেকে, ৭. কার্তিক এসেছে কার্তিকা থেকে, ৮. অগ্রহায়ণ এসেছে আগ্রাইহন থেকে, ৯. পৌষ এসেছে পৌষিয়া থেকে, ১০. মাঘ এসেছে মাথা থেকে, ১১. ফাল্গুন এসেছে ফাল্গুনি থেকে ও এবং ১২ চৈত্র এসেছে চিত্রা থেকে। রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরগুলোতে প্রতি বছর নানা বর্ণিল আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। প্রাণের টানে বয়সের পিছুটানকে উপেক্ষা করে প্রতি বছর চেষ্টা করি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু ছোটবেলায় আব্বার হাত ধরে বটতলায় বা নদীর তীরের বৈশাখি মেলায় যাবার স্মৃতি কিছুতেই ভুলবার নয়। ঢাকায় বৈশাখ উদযাপনের সব বর্ণানে আয়োজন যেন এর কাছে জ্ঞান হয়ে যায়। তাই বৈশাখের আগমন মুহূর্তে আমার ভিতর স্মৃতির পাপড়িরা ডানা মেলতে শুরু করে। ভুলতে পারিনা চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন থেকে মা-চাচী-দামীদের ব্যস্ততার কথা। বৈশাখকে ঘিরে তখনকার আটপৌরে গ্রামীণ জীবনের ভিতর বাড়ির দৃশ্য ছিল এমনি। মা-চাচীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন চৈত্র সংক্রান্তির দিন আর পহেলা বৈশাখের দিনের খাবার আয়োজন নিয়ে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে সব ধরনের শাক খাওয়ার রীতিটা ছিল বহুদিনের প্রচলিত প্রথা। বিগত বছরের সমস্ত জরা-ব্যাধি দূর হয়ে যাবে-এই বিশ্বাসে প্রচলিত-অপ্রচিত সব ধরনের শাকের সমাহার ঘটত চৈত্র সংক্রান্তির দিনের দুপুরের খাবারে। তার সাথে চলত ঘর- বাড়ি ঝাড়-মোছের কাজ। বিদায়ী বছরের সমস্ত ধুলো-বালি- ময়লা-আবর্জনা দূর করে ঝকঝকে-তকতকে করে তোলা হতো বাড়িঘর। যাতে বৈশাখের আগমন ঘটে সূচী-শুভ- পবিত্রতার মধ্য দিয়ে।

মা-চাচীদের এই ধরনের আয়োজন আমাদের অর্থাৎ ছোটদের মনে বৈশাখকে ঘিরে বাড়তি উদ্দীপনা জাগিয়ে দিত। পরের দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। জমবে বৈশাখি মেলা। এর আগাম আনন্দবার্তা নিয়ে আসত চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি। সারারাত উদ্দীপনায় আমাদের ঘুম হতোনা। যেমনটি হতো চাঁদ রাতের বেলায়। অপেক্ষায় থাকতাম কখন রাত পোহাবে। বৈশাখি মেলায় যাব। হাতি-ঘোড়া-পুতুল কিনব। সবচেয়ে মজা পেতাম খাওয়ার হাতি-ঘোড়া কিনতে পেরে। আমাদের দেশে। এগুলোকে বলে সাজি। সাজি কিনতে না পারলে মনে হতো মেলায় যাওয়াটাই বৃথা গেল। সাথে কিনতাম বিন্নি ধানের খৈ। আর কিনতাম মাটি দিয়ে বানানো রং বেরং এর পুতুল, বাঁশী, আরও নানা ধরনের খেলনা। মা-চাটীদের এই ধরনের আয়োজন আমাদের অর্থাৎ ছোটদের মনে বৈশাখকে ঘিরে বাড়তি উদ্দীপনা জাগিয়ে দিত। পরের দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। জমবে বৈশাখি মেলা। এর আগাম আনন্দবার্তা নিয়ে আসত চৈত্রসংক্রান্তির দিনটি। সারারাত উদ্দীপনায় আমাদের ঘুম হতোনা। যেমনটি হতো চাঁদ রাতের বেলায়। অপেক্ষায় থাকতাম কখন রাত পোহাবে। বৈশাখি মেলায় যাব। হাতি-ঘোড়া-পুতুল কিনব। সবচেয়ে মজা পেতাম খাওয়ার হাতি-ঘোড়া কিনতে পেরে। আমাদের দেশে এগুলোকে বলে সাজি। সাজি কিনতে না পারলে মনে হতো মেলায় যাওয়াটাই বৃথা গেল। সাথে কিনতাম বিন্নি ধানের খৈ। আর কিনতাম মাটি দিয়ে বানানো রং বেরং এর পুতুল, বাঁশি, আরও নানা ধরনের খেননা।

বৈশাখের সকাল বেলাতেই রান্নাঘরে দেখতাম আম্মার অন্যরকম ব্যস্ততা। নানা রকম পিঠে দিয়ে নাস্তা হবে। এখনকার মতো সকালবেলা পান্তা ইলিশ দিয়ে নাস্তা খাওয়ার রীতি গ্রামে তখনও ছিলনা, এখনও নেই। নাস্তার পর দুপুরের খাবারের আয়োজনে লেগে যেতেন আম্মা। কারণ, পহেলা বৈশাখের দিনের দুপুরের খাবার অন্যদিনের মতো গতানুগতিক হলে চলত না। সাধ্যমতো বছরের প্রথম দিনটিতে ভালো ভালো খাবারের আয়োজন চলত ঘরে ঘরে। বিশ্বাস এই যে, পহেলা বৈশাখের দিন ভালো খাবার খেলে সারা বছর এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অভাব আর দারিদ্রের নিষ্পেষণে জর্জড়িত গ্রাম বাংলার মানুষের এই বিশ্বাস কতটুকু ফলপ্রসূ হতো তা আজও জানার অতীত। তবে আজও গ্রামের মানুষ এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছে বৈশাখি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। আজকাল যেমন শহরে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন কাপড় পড়ার প্রচলন দেখতে পাই তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে তো বটেই শহরেও এমনটি ছিলনা। আমাদের গ্রামাঞ্চলের সেই আবহ এখনও বজায় থাকলেও পাল্টেগেছে শহুরে আনুষ্ঠানিকতা। আমরাও কখনও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন পোশাকের জন্য বায়না ধরতাম না। আব্বা আমাদের চাহিদামতো সব ধরনের খেননাপাতি ও খাবার জিনিস কিনে দিতেন। তাই নিয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতাম আমরা। বাড়ি আসার পথে সেই কি দুশ্যা চোখের পর্দায় এখনও লেগে আছে যেন। মেলাফেরত মানুষের মিছিল। সব বাচ্চাদের হাত ভর্তি জিনিসপত্র। বাঁশীর প্যাঁ পোঁ শব্দে মুখর হয়ে উঠত চারপাশ। বাড়ি ফিরেই বসে পড়তাম কার কোন খেলনাটা কত সুন্দর হয়েছে সেটা ঠিক করতে।

আজ বহুদূর ফেলে এসেছি সেই পহেলা বৈশাখের দিনগুলো। আমার মা-বাবা কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু মহাকালের চিরায়ত নিয়মে আজও বৈশাখ আসে। নববর্ষের উদ্দীপনায় মেতে উঠি আমরা। শহরের কোলাহলমুখর ব্যস্ততায় আমার মা-চাচীদের আটপৌরে আয়োজনে উদযাপিত পহেলা বৈশাখের দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না সেই বটতলার কথা, নদী তীরের কথা। আমার কানে আজও বাজে সেই বাঁশীর সুর। বৈশাখি মেলা থেকে কিনে যে বাঁশীর সুরে চারদিক মাতিয়ে তুলতাম আমরা। আজ মনে হয় আমার প্রাণের নির্মল উচ্ছ্বাসটুকু জড়িয়ে আছে বাঁশীর সেই সুরের সাথে। তাই বৈশাখের আগমন মুহূর্তে ছোটবেলার কথা স্মরণ করে বুকের ভিতর অন্যরকম ভালো লাগার অনুভবে আজও আলোড়িত হই আমি। আমার বুকের ওমে পরম আদরে পুষে রাখা সুখের ছোট্ট সুখপাখী এটি। আমৃত্যু আমার মনে সুখের সরোবর হয়ে বেঁচে থাকবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ