জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জ জয় করতে চাই সহনশীলতা
কঠিন পরিস্থিতির মুখেও নিজেকে স্থির রেখে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষমতা সবার সব সময়ে থাকে না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, রেজিলিয়েন্স ফ্যাক্টর সম্পর্কে শিখে সেই ক্ষমতা আয়ত্ত করা সম্ভব৷ জার্মানিতে এ রকম এক উদ্যোগ চলছে।
কোন কোন বিষয় মানুষকে জীবনের বিভিন্ন সংকট সামলাতে সাহায্য করে, মনোবিজ্ঞানী হিসেবে ইসাবেলা হেল্মরাইশ সে বিষয়ে গবেষণা করছেন৷ ইংরিজি ভাষায় যাকে রেজিলিয়েন্স বলা হয়। তিনি ও তার সহকর্মীরা সেই লক্ষ্যে মানুষের মস্তিষ্কে উঁকি মারছেন।
জীবনে নানা চ্যালেঞ্জ সামলানোর ক্ষমতাকেই রেজিলিয়েন্স বলা হয়৷ বিজ্ঞান এর তিনটি মৌলিক রূপ চেনে। উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সহজ করতে ইসাবেলা বলেন, ‘‘আমি এই ছোট রেজিলিয়েন্স বনসাই নিয়ে এসেছি৷ কারণ প্রতিকূলতা ও খারাপ ঘটনার মুখে মানুষের কত রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে, আমার মতে সেটা এর মাধ্যমে ভালো করে দেখানো যায়৷ এবার জীবনের বাতাস আসছে৷ গাছ বেঁকে যাচ্ছে৷ কিন্তু নীচে গুঁড়ির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, সেটি শক্ত ও অনমনীয় রয়েছে৷ স্ট্রেস অনেক মানুষকে ছুঁতে পারে না৷ তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে৷ অন্য মানুষ এমন পরিস্থিতিতে ভালো থাকে না৷ তাদের হয়তো স্ট্রেস সিন্ড্রোম হয়৷ কিন্তু বাতাসের ধাক্কা বন্ধ হলে তারা আবার নিজেদের সামলে নেয়৷ তাকে রিজেনারেশন বলা হয়৷ আমাদের বনসাই গাছের মতো তারাও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে আবার বাড়তে বা এগোতে থাকেন৷ তৃতীয় ধরনকে রিকনফিগারেশন বলা হয়৷ সে ক্ষেত্রে গুঁড়ির মধ্যে পরিবর্তন ঘটে৷ আমাদের বনসাই অনেক সময় ধরে আলো না পাওয়ায় সংকটে ছিলো৷ কিন্তু তারপর সেটি নতুন দিকে বাড়তে শুরু করলো৷ উদাহরণ হিসেবে কোনো ক্যানসারের রোগীর উল্লেখ করা যায়৷ তার মধ্যে নতুন ক্ষমতা ও দক্ষতা জন্মায়, নতুন আইডিয়া আসে৷ এভাবে তারা সংগ্রামের জন্য আরো ভালোভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়৷ যেমন জীবনে কোন বিষয় সত্যি জরুরি সেটা বুঝে তারা নতুন দিশায় চলতে শুরু করে৷ যেমন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের পছন্দের শখের প্রতি মনোযোগ দেয়।”
আগে মানুষ ভাবতো, যে রেজিলিয়েন্স বোধহয় ব্যক্তিত্বের একটা গুণ এবং অত্যন্ত অনমনীয় বৈশিষ্ট্য৷ কেউ বেশি রেজিলিয়েন্ট, অন্যরা হয়তো কম৷ আজ গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সেই ক্ষমতা বার বার বদলাতে পারে৷ মাইনৎস শহরের গবেষকরা সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিখুঁতভাবে জানতে চান৷ সেই পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে ইসাবেলা হেল্মরাইশ বলেন, ‘‘আমরা মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করি৷ কারণ রেজিলিয়েন্ট মানুষের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, যে তাদের মস্তিষ্কের অনেক কাঠামো আরো স্পষ্ট, পরস্পরের সঙ্গে আরো ভালোভাবে সংযুক্ত। যেমন আবেগ বিশ্লেষণের অংশ অ্যামিগডালা৷ মস্তিষ্কের সামনের দিকে চিন্তা ও পরিকল্পনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশ হিসেবে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সেও সেটা দেখা যায়৷ সেই কাঠামোগুলিকে প্রশিক্ষণও দেওয়া যায়।”
মস্তিষ্কের গবেষণা ও অন্যান্য সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষকরা দশটি তথাকথিত ‘রেজিলিয়েন্স ফ্যাক্টর’ শনাক্ত করেছেন। এমন সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সংকটের সময় আমাদের আরো শক্তিশালী করে তোলে৷ সেগুলির প্রমাণও পাওয়া গেছে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপ করাও সম্ভব৷ প্রধান বিষয়গুলি তুলে ধরে ইসাবেলা হেল্মরাইশ বলেন, ‘‘একদম উপরে সামাজিক সহায়তার বিষয়টি রেখেছি, কারণ সেটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেজিলিয়েন্স ফ্যাক্টর৷ সক্রিয়ভাবে পরিবর্তন আনার ক্ষমতাকে অ্যাক্টিভ কোপিং বলা হয়৷ বদ্ধমূল ধারণার দাস হয়ে না থেকে নতুন পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাবনার ক্ষমতা কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি হিসেবে পরিচিত৷ আমার পছন্দের ফ্যাক্টর হলো ইতিবাচক আবেগ৷ বিশেষ জোরালো আবেগের বদলে সেই আবেগ ঘনঘন আসা জরুরি। রেজিলিয়েন্ট মানুষ জীবনের তুচ্ছ অথচ সুন্দর বিষয়ের প্রতিও নজর দেন৷ যেমন সুন্দর এই গাছ৷ সে কারণে তারা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সুন্দর এই দৃশ্য মনে ধরে রাখতে পারেন।’
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই সব গুণাগুণ আয়ত্ত করা সম্ভব বলে ইসাবেলা হেল্মরাইশ ও তার টিম এক ইউনিট চালু করেছেন৷ সেখানে মানুষ কোনো কোর্সে বাকিদের সঙ্গে অথবা একা কোচিংয়ের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে রেজিলিয়েন্স ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানতে এবং সেগুলি প্রয়োগ করতে পারেন৷
এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্তকেই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ বিফল হলেও সেই অভিজ্ঞতা থেকে ভালো কিছু উঠে আসতে পারে৷ ইসাবেলা মনে করেন, ‘‘হেরে যাওয়া অবশ্যই ভালো অভিজ্ঞতা নয়৷ কিন্তু সেটাও জীবনের অংশ৷ কোনো মানুষ একেবারেই কোনো সংকট ছাড়া জীবন কাটাতে পারেন না৷ সে কারণে হেরে যাওয়ারও অনুশীলন করতে হবে৷ সেটাও মানুষকে বোঝানো উচিত৷ বিফল হওয়া ভালো৷ সেটা থেকে আমি কিছু শিখতে পারি৷”
অনন্যা/এআই