Skip to content

১০ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উড়াল

গোরস্তানের বাইরে সীমানা বেড়ার পাশে বৃদ্ধ বকুল গাছটির নিচে বসে ঝিমুচ্ছিল ময়না। হঠাৎ সারাটা গা কেঁপে উঠে ওর। ভীষণ শীত শীত লাগছে। কিছু মনে করতে পারছে না, কখন সে গোরস্তানে এসেছে। কিছুদূর এগিয়ে বাইরের এই গাছটির গোড়ায় বসে পড়ে। আম্বিয়া দেখতে পায় ময়নাকে। ওর মায়ের কবর জিয়ারত করতে এসেছিল সে সকালে। দৌড়ে ওর কাছে যায়-কিরে এখানে বসে ঝিমুচ্ছিস কেন? ওঠ বাড়ি চল। ঘর- বাড়ি ছাইড়ে গোরস্তানে পড়ি থাকলি কি তোর মাইয়‍্যা ফিরে আসপেনে?

ময়না হা করে তাকিয়ে থাকে বড় বোনের দিকে। বলে শীত করতিছে, ঠাণ্ডা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ যে ওর পিঠে পাখায় ভর দিয়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে আইলো। কী সব আবল তাবল বকতিছিস? চল বাড়ি চল। শোন ময়না, আল্লাহর মাল আল্লাহই নিয়ে গেইছে। কারও হাত আইছে ধইরে রাখপের পারে। তুই কি মেয়ে জন্যি পাগল হইয়ে যাচ্ছিস?

ময়না সম্বিত ফিরে পায়। উঠে দাঁড়ায় বোনকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে, নেই আমার মাইয়্যাডা নেই বু। তেরো বছরের ফুটফুইট্যে সুন্দর লাউয়ের ডগার মতো লম্বা লকলইক্যা মাইয়‍্যাডা নেই। দুই দিনের জ্বরে ক্যাবা কইরে মইরে গেলো। ও বুক কেন গেলো?

বড় বোন আম্বিয়ার চোখ ভেসে যায় জলে। ময়নাকে বুকের ওমে টেনে নেয়। আদর করে। মাথা-গা শাপটে দেয়। বলে, কী কব ক। এর মইধ্যে কোনো ভালো কিছু আইছে না কি? তাই মানতি হবি।

তোর বড় দুইখান ছাওয়াল আছে। ওগের দিকে তাকিয়ে বাঁচার পথ খুঁইজে নেয়া লাগবিনে। চল বাড়ি চল। আমার কাছে কিছু দিন থাক। ভালো লাগবিনে। ময়না চুপ করে থাকে। কী করবে ময়না পাঁজরের হাড় একখণ্ড পড়ে আছে এখানে। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় শরীর মন ওর। তবু বড় বোনের কথায় দেহটাকে ঠেলে নিয়ে চলে। ময়নার বড় দুই ছেলে অল্প বয়সেই বিয়ে থা করে শ্বশুর বাড়ির ভিটা দখলে ব্যস্ত। ওর স্বামী মারা যাওয়ার পরে এই একটি মেয়েকে সম্বল করেই ওর জীবনের পথ পরিক্রম। সে-ই তার বন্ধু-মা-বোন। সুখে-দুঃখের সঙ্গীও। তাকে ঘিরে সে আবর্তিত। জীবনের মানে খুঁজে পায় ময়না তার মেয়ে সোনালীর শরীরের ঘ্রাণে। শোকে তাপে বেহাল অবস্থায় সোনালীকে দেখে দেখে জীবনে শ্বাস নিতে পারছিল। রূপে-গুণ মেয়েটি অধরা। লেখপড়াও করেছিল স্কুলে। মেয়ে বড় হবে চাকরি করবে-কতই স্বপ্ন ময়নার। মনে মনে ওর জন্য ঘর জামাইও খুঁজে রেখেছে। ওর ফুপাতো বোনের ছেলে আনোয়ার। ভীষণ ভদ্র ছেলে। তাকে ভারী সম্মান করে। তারও মনে ধরেছে সোনালীকে কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলেনি। সোনালীও পছন্দ করে আনোয়ার ভাইকে কিন্তু মায়ের পছন্দ মায়ের ঘর জামাই বানানোর স্বপ্ন কাকে দিয়ে পূরণ হবে, তা তো জানে না সোনালী। নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করেনি কখনও। দুঃখের মাঝেও আশার পিদিম জ্বালিয়ে রেখেছিল আনোয়ার। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনটি সন্তানকে আগলে রেখেছে ময়না যক্ষের ধনের মতো। এর মধ্যে বড় দুটো পাখি উড়াল শিখে তাকে ছেড়ে চলে যায় অন্য নীড়ে। তারা সেখানে বাসা তৈরিতে ব্যস্ত। মেয়েটা তার আশালতা। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ময়না।

ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে। আম্বিয়া বলে, কয়দিন আমার বাড়ি থাকপের পারিসনা? মন ভালো ঠেকলি চইলে যাইস। দুই বইন গল্প কইরে কাটাবোনে। পুকুর পাড়ে আড্ডা জমাবোনে। সইন্ধা তামাত বইসে থাকপোনে পানির দিকে চাইয়ে চাইয়ে। বোবা দৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে শোনে বড় বোনের কথা। আর ঘাড় কাত করে উত্তর করে। এতটুকুই। দুই চোখে এক পুকুর স্বচ্ছ জল টলমল লাল টুকটুকে গায়ের রঙ। পটে আঁকা ছবি। আম্বিয়া চেয়ে চেয়ে দেখে বোনকে। আর বলে এখনো তোক বিয়ে দেয়া যাবেরে ময়না। এত রূপ নিয়ে কী কইরে পার করলি এ জেবন? এহেবারে এহলা এহলা। ব্যাটা মানুষগুলো এখনো তোর জন্নি পাগল হইয়ে ঘুরতিছে। ময়নার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। হাসি ভুলে গেছে। আম্বিয়া ওর গায়ে একটু ধাক্কা দিয়ে কয়, নাওয়া-খাওয়া, কথা-হাসি-সবই ভুইলে গেইলে চলবি কেবা কইরে?

এবার মুখ খোলে ময়না। বলে, কবুক। কার জইন্নি আমার এই জেবন। আমার আইন্ধার ঘরের মানিক সেই তো আমার ছাইড়ে চইলে গেলো। আমি বাঁইচপো কী নিয়ে। যত সুখ কিচ্ছা সব তিন হাত মাটির তলে গাইড়ে রাইখে আলাম।

আবার চুপ করে বসে থাকে। এভাবেই দিনগুলো গড়িয়ে যায়। প্রতি রাতেই ময়নাকে নিশি ডাকে। তার পিছু পিছু দরজা খুলে হেঁটে চলে যায়। ওই পুকুরপাড় বুড়ো বকুল গাছটির তলায় ঝিম ধরে বসে থাকে। আম্বিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় ওকে পায় না। শীতে কাঁপা কাঁপা ঠাণ্ডা শরীর। আম্বিয়া ওকে চাদরে ঢেকে নিজের দেহের ওম লাগিয়ে ঘর নিয়ে আসে। দুই চোখে জল। মুখে বিড়বিড় করে কীযেন আওড়ায় ময়না। আম্বিয়ার সংবেদনশীল মনের আয়নায় মেয়ে ও মায়ের বিম্বিত ছায়া চোখে জল হয়ে ঝরে পড়ে। বোনকে আগলে রাখে যত দিন না সেএই স্মৃ তি মুছে বাস্তবতায় ফিরে আসে। হ্যালোসিনেশনে ডুবে যাওয়া ময়নার উত্তরণ জরুরি।

নিত্যই উড়ন্ত ডানায় ভর করে উড়াল দেয় যত্রতত্র ময়না। দৃষ্টিতে অন্বেষণ একটিই-মুখ একটি শরীরে একটি আত্মা। ওর চোখে ভেসে ওঠে ওর মেয়ে সোনালীর নিত্যদিনের কর্মময় জীবনের বাইস্কোপ। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর বলে আয় মা আয় কতদিন দেখিনা তোরে। আয় কাছে আয়। মাথাটা বাইন্ধা দেই। কী যে উস্কাখুষ্কা কইরা রাখিছিস। কেশবতী কইন্যা আমার মেঘবতী চুল। এমনে আওলা বাতাসে উড়াইয়া রাখছোস ক্যান? আয় বেণী গাইখ্যা দেই। কতদিন সুনো ক্রিম পড়ে নাই মুখটার মইধ্যে। সোনার বরণ ময়লা হইয়া গেছে। কতদিন দেখি না তোরে বুকটার মইধ্যে খা খা কইরা আগুন জ্বলতাছে। তোর লাইগ্যা খাওন নিয়া যামুনে কাইল। সত্যি সত্যি কিছু খাবার প্যাকেট করে মেয়ের জন্য ময়না। আম্বিয়া কিছু বলে না। ওর কোনো কাজেই বাধা দেয় না। মনপোড়া মানুষ যাতে আনন্দ পায়, তাই করুক।

সারাটা দিন ভালোই ছিল। রাতে ঘুম আসে না ময়নার। গা গরম জ্বর জ্বর লাগছে। আম্বিয়া রাতে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে গেছে। সারাটা রাত নির্ঘুম ময়না আবোল তাবোল বকেছে। রাত পোহানোর অপেক্ষায়। খাবারের পোটলাটি নিয়ে রাতেই শীত কুয়াশায় বেরিয়ে পড়ে। নিশি ডাকে তার পিছু পিছু ছুটছে। পথে যেতে যেতে আওড়াতে থাকে, ‘এই উড়াল জিন তুই আমাকে কই নিয়ে যাচ্ছিস। ‘উত্তরও পায় জিনের কাছে। কতদিন না তুই ওর জন্য অপেক্ষায় আছিস। আজই তোকে নিয়ে যাবো তোর মেয়ের সঙ্গে দেখা করাতে।

খুশিতে ডগমগ হয়ে যায় ময়না। যাও উড়াল জিন যাও। আরও জোরে আরও জোরে। আমি তোমার পিঠে বইসে ডানা দুটো চাইপে ধইরে রাখছি। কী ঠাণ্ডা বাতাস।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ