Skip to content

১০ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাস সমৃদ্ধ দুই মসজিদ

বাংলাদেশে মসজিদ রয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অসংখ্য ইতিহাস সমৃদ্ধ মসজিদ রয়েছে। কোনোটির ১৩০০ বছর আগের, আবার কিছু মসজিদের বয়স ২৫০ হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে দারুণ কিছু দৃষ্টান্ত। এমন অসংখ্য মসজিদের মধ্যে মাত্র তিনটি মসজিদের স্বল্প আলোচনা করা হলো এই আয়োজনে–

হারানো মসজিদ – ১৩৭৭ বছরের পুরোনো ইট থেকে পরিচয়
তানভীর আহমেদ |

লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রাম। দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি ফসলের মাঠ। এখানেই ১৩৭৭ বছর আগে নির্মিত এক মসজিদের খোঁজ মিলেছে! যেটিকে এখন এশিয়ার প্রথম মসজিদও বলা হচ্ছে।
১৯৮৭ সালের কথা কথা। ভয়ঙ্কর জঙ্গলে ঘেরা এক উঁচু স্থান পরিস্কার করতে নেমেছিল গ্রামবাসী। আশপাশের জায়গার তুলনায় ৮-১০ ফুট উঁচু সেই স্থানটি। দিনের বেলায়ও সেখানে ছিল ঘোর অন্ধকার। জঙ্গলটি পরিষ্কার করার সময় কিছু প্রাচীনকালের ইট বেরিয়ে আসে। মাটি ও ইট সরাতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় মসজিদের ভিত।
কথা হলো, এরকম পোড়া মাটির স্থাপত্যতো বাংলাদেশে এর আগেও অনেক পাওয়া গেছে। তাহলে এটার বিশেষত্বটা কোথায়? রহস্যটা হলো, এই মসজিদ কে বা কারা নির্মাণ করলো সেটা নিয়ে। সেইসব পোড়া মাটির ফলক কার্বন ডেট করে প্রত্নতাত্ত্বিকবিদরা নিশ্চিত হয়েছে, এর নির্মাণকাল আনুমানিক ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি বা ৬৯ হিজরিতে। এর মানে এটি এক হাজার ৩৭৭ বছর আগের মসজিদ!

মসজিদের ধ্বংসস্তূপে যে শিলালিপি পাওয়া যায় তাতে সুস্পষ্টভাবে আরবিতে লেখা আছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, হিজরি ৬৯ সাল।’ শিলালিপির সূত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৬৯ হিজরিতে নির্মিত হয়েছে এ মসজিদটি। খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদসংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও খুতবার মিম্বরও আবিষ্কৃত হয়। এলাকার লোকজন এ মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ’।
ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন, সাহাবি হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) এ অঞ্চল দিয়েই চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বর্তমানে চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তার নির্মিত মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিল দাবি করেন, খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পাড় ধরে সিকিম হয়ে চীনের মধ্য দিয়ে আরব ও রোমান বণিকদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণ রয়েছে তার কাছে। এ হারানো মসজিদ হতে পারে সাহাবি আবু ওয়াক্কাস (রা.) নির্মাণ করেছেন।
তবে ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের এই মসজিদ নির্মাণ অবাক হওয়ার কিছু নয় কারণ বাংলায় সভ্যতার বিকাশ সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে যা কি-না প্রাচীন রোমান, গ্রিক, পারস্যের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। এই মসজিদের নির্মাণের সময় বাংলায় খড়গ বংশের শাসন চলছিল; যারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী।

পাগলা মসজিদ – খরস্রোতা নরসুন্দার তীরের এক আধ্যাত্মিক পুরুষের স্মৃতি নুহিয়াতুল লাবিব |

কিশোরগঞ্জে শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। মসজিদটির ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমত্কার। তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। কিন্তু এই মসজিদের সৃষ্টি কীভাবে?

মহাবীর ঈশা খানের অধস্তন পুরুষ দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিলকদর পাগলা দুনিয়াদারি ছেড়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় একাকী জীবনযাপন করতেন। ফলে তিনি মানুষের কাছে ‘পাগলা সাহেব’ বলে পরিচিত ছিলেন। এই আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিত হন এবং তাকে ঘিরে আশেপাশে অনেক ভক্তকূল সমবেত হন। তার ইবাদত-বন্দেগির জন্য দেওয়ান পরিবারের পক্ষ থেকে পাগলা সাহেবের নিজের পছন্দের স্থান নরসুন্দা নদীর মাঝখানে টিলার উপর একটি টিনের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। ওই ঘরটি পরবর্তীতে ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এমন জনশ্রুতিই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তত্কালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের এক নিঃসন্তান বেগমকে জনগণ ‘পাগলা বিবি’ বলে ডাকত। দেওয়ানবাড়ির এ বেগম নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে ‘পাগলা বিবির মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।

পাগলা মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কাছে নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে সব ধর্মাবলম্বীর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন। নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। অধিক দান-খয়রাতের কারণে পাগলা মসজিদ ইতিমধ্যেই দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ