এখনো পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নারীর অভিমত নেওয়া হয় না: তামান্না আফরিন
প্রশ্ন ১: একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে এখনও কি নিজের অধিকারের জায়গা গুলো নিশ্চিত হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
তামান্না আফরিন: না। একুশ শতকে এসে আমরা আজও কোথাও যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমি একজন আইনজীবী হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগে কাজ করছি। আমি প্রতিদিন মানুষের আইনগত অধিকারের জন্য লড়াই করি। আমি আমার আইন পেশার পাশাপাশি মিডিয়াতে কাজ করি উপস্থাপনা করি এবং রাজনীতি করি। আমাকে প্রায়ই সকাল ১০ টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চেম্বার ওয়ার্ক করতে হয়। আমি যখন রাতে বাসায় ফিরছি তখন আমার স্বামী, শাশুড়ি কখনো প্রতিবেশী দরজা খুলে যখন দেখছে আমাকে তখন বলছে যে তুমি এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী কাজ করো? একটা সন্দেহ তারা ভাবে যে নারীটা এত রাত পর্যন্ত কাজ করে, সে নারীটা আসলে খারাপ। পুরুষের বেলায় কিন্তু এরকম সন্দেহগুলো আসে না। দ্বিতীয়ত, আমি হয়তো আমার যোগ্যতা অনুযায়ী আমার সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী কাজ করছি কিন্তু আমাকে প্রায়ই আমার স্বামীর কাছ থেকে শুনতে হয় যে আমি তোমাকে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছি । তৃতীয়ত, একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে কর্মঘণ্টা শেষে বাসায় ফিরে মেলে না অবসর। পেশাগত পরিচয়ের পরেও আমি একজন মা, একজন স্ত্রী এবং পরিবারের বধূ। দায়িত্বের জায়গায় ছাড় নেই একটুও। আমরা মেয়েরা পরিবারে হয়তো নিজের উপার্জনের টাকা কম খরচ করি, সেজন্য আমি যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে বাসায় ফিরছি সেই কাজের স্বীকৃতিটুকুও আমরা পাই না। চতুর্থ, আমার স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই যে বিষয়টাতে বিরোধ হয়, সেটা হলো যে পারিবারিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার অভিমত নেওয়া হয় না। যেটা আমার অধিকার। আমি এই বিষয়টাতে খুবই কষ্ট পাই। পঞ্চমত, আমাদের কর্মজীবী মায়েদের অন্যতম একটা সমস্যা হলো সন্তান ও পরিবারকে আমরা যথেষ্ট সময় দিতে পারি না। এক্ষেত্রে ভালো মা এবং খারাপ মা হিসেবে দেখা হয়। পুরুষতান্ত্রিক ধারণায় একজন ভালো মা সন্তান লালন পালনের জন্য তার সকল স্বপ্ন-শখ-অর্জনকে ত্যাগ করে। যেহেতু আমি সন্তানের জন্য আমার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিচ্ছি না সেহেতু সন্তানের সামনে আমাকে দেখানো হয় যে আমি একজন খারাপ মা।
প্রশ্ন ২: নারীদের জন্য আলাদা দিবস থাকা কি আসলেই দরকার আছে?
তামান্না আফরিন: আপনি কি সেই নারী বা পুরুষ, যিনি মনে করেন নারীর জন্য নিরাপদ পথ, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র এগুলো সৃষ্টি অসম্ভব? নারীর গায়ে ‘হাত তোলা’ ‘হাত লাগা’ ‘হাত পড়া’—এসবই নারীর ভবিতব্য। কাজেই সইতে না পারলে বরং ঘরে বসে বাচ্চা পালনই নারীর জন্য ভালো? তারপর আপনি যখন শোনেন, এ দেশে ঘরেই সবচেয়ে বেশি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় নিকটাত্মীয় এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের দ্বারা। আপনার আবার মনে হয়, মেয়েশিশুর ‘পোশাক’, ‘চলনবলন’ বা ‘পারিবারিক শিক্ষায়’ কোনো অসুবিধা ছিল? বা আপনি কি মনে করেন, এমন হয়, হয়ে যেতেই পারে? বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর হাতে মার খান, তাঁদের অনেকের অঙ্গহানি ঘটে, প্রাণও যায়। সমতার প্রশ্ন এলেই পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনীতির নানা বাস্তবতা তুলে ধরতে ইচ্ছা করে? আপনার যুক্তি কি এমন যে আগে তো নারীরা সেনাবাহিনী–পুলিশে ঢুকতেই পারতেন না, এখন তো শুনি যুদ্ধবিমান চালাচ্ছেন! মানে, যুক্তিটা কি ওই মানের যে যানজট, নিরাপদ সড়ক, বায়ুদূষণ—এসব নিয়ে কথা বলার কী আছে, আগে তো কারও পায়ে স্যান্ডেল আর নারীদের গায়ে ব্লাউজই ছিল না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং স্পিকার—সব নারী কিন্তু ৩০০ জন নির্বাচিত সাংসদের মধ্যে বাংলাদেশে মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি নারী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাবার আসন, বাবার এলাকা রাজনীতিতে প্রবেশের সবচেয়ে মোক্ষম চাবি। এ দেশে নারীদের উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা থাকা জমির পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি নয়। আপনি অবাক?জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান, ধর্ম অনুযায়ী পুত্রের অর্ধেক সম্পদ কন্যার পাওয়ার কথা, তাহলে জমির মালিকানায় এমন বৈষম্য এই দেশে কেন? যা–ই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। তার মানে, নারীর জমি নেই, বাড়ি নেই, এলাকা নেই—কাজেই ব্যবসার ঋণের জন্য, দলের পদের জন্য, নির্বাচনের আসনের জন্য তাঁর বিবেচিত হওয়ার সুযোগও নেই।
ভাবছেন সমতা অর্জিত হয়ে গেছে? নারীর আবার আলাদা সুবিধা, আলাদা দিবস দরকার কী—এ রকম ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর একদল ছাত্রীও নারী কোটা বাতিল চাইলেন এবং সব কোটাই বাতিল হলো। অথচ গত চারটি বিসিএসে দেখা গেছে, কোটাসুবিধা বহাল থাকার পরও নারীদের চাকরি পাওয়ার হার ৩৮ শতাংশ থেকে কমে ২৬ শতাংশে এসেছে। যে নারীরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে বিশ্ব জয় করবেন ভাবছেন, বিসিএস পরীক্ষা যত দিনে হবে, তত দিনে তাঁদের বিয়ে হবে, সন্তান হবে, পরীক্ষা দিতে স্বামীর অনুমোদন লাগবে, স্বামী–সন্তানের দেখভালের ব্যবস্থা করে তবে তাঁকে পরীক্ষায় বসতে হবে। চাকরি হলে শ্বশুরবাড়ির অনুমতি নিয়ে যেতে হবে, অনেক ক্ষেত্রেই আর তা করা হয়ে উঠবে না। ডানা কাটা পড়বে।
এই ডানা কাটার ব্যবস্থা যত দিন থাকবে, তত দিন নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে। ডানা কাটার পক্ষে যুক্তিধারী মানুষের সংখ্যা যত দিন ১০ জনে ৯ জন থাকবেন, তত দিন নারী দিবসের বদলে মানুষ দিবস করার সুযোগ ঘটবে না। আর আপনি যদি হন ৯ জনের বাইরে থাকা ১ জন নারী বা পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করা মানুষ, তবে আপনার কাজ, আজ থেকে চারপাশের অসাম্যের বিরুদ্ধে আপনার সাধ্য অনুযায়ী কিছু করা। আপনি জীবনসঙ্গী হলে সংসার আর সন্তান লালনপালনে কাজ ভাগ করে নিন, ভাই বা বোন হলে সম্পদে ন্যায্য অধিকারের ব্যবস্থা করুন, বাবা বা মা হলে সন্তানকে বলুন, কখনো কোনো পরিস্থিতিতে তার ডানা আপনি ছেঁটে দেবেন না। আমাদের মাত্র ১০ শতাংশের পৃথিবীর সমতার মুক্ত আকাশে পাখা মেলে উড়ুক আমাদের সন্তানেরা—নারী বা পুরুষ হয়ে নয়, মানুষ হয়ে। আমাদের আকাশে বাড়তে থাকুক পাখিদের ভিড়।
প্রশ্ন ৩: নারী দিবসে নারী হিসেবে আপনার চাওয়া কী থাকবে?
তামান্না আফরিন: নারী দিবস সার্থক হবে তখন যখন মেয়েরা বাড়ি ফিরতে দেরি হলে চিন্তা হবে না, নারীরা অত্যাচারিত হবে না এবং নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। শুধু একদিন নারী দিবস পালন করে নয় বরং নারীদের সম্মান করা হবে প্রতিদিন প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি পরিবারে। নারীরা শিক্ষা অর্জন করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করবে, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হবে। পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজের ভালো-মন্দ বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে। সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর হোক এবং নারীতান্ত্রিক মনোভাব তৈরি হোক শত বাধা পেরিয়ে নারীরা এগিয়ে যাক।