Skip to content

২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডিভোর্স: পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি

বাঙালি এখন আধুনিক যুগের কর্ণধার! ডিজিটাল জীবন, ডিজিটাল পড়াশোনা সবই ডিজিটালি করে থাকেন তবে চিন্তা-ভাবনা ও জীবনের দোরগোড়ায় তার অনুপ্রবেশ কিঞ্চিৎও রয়েছে কিনা তাতে বিশেষ সন্দেহ থেকে যায়! কথায় কথায় নারীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা তাদের এক ধরনের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা একমাত্র নারী, পুরুষ সেখানে নস্যি! বিয়ে ভাঙলো-দোষ কার? নারীর। ধর্ষণ হলো! দোষ কার? নারীর! যৌন হেনস্তা হলো- দোষ কার, অবশ্যই নারীর। কারণ নারী যদি ড্রেসআপ ঠিক রাখতো, ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো -তাহলে সে নিশ্চিতভাবেই এমন আচরণের শিকার হতো না!

কী আশ্চর্য বাঙালি জাতি! তাদের মানসিক বৈকাল্য দেখে চিন্তার গভীরতায় ডুব দিতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে তাদের মুক্তি নেই। তারা নারীর প্রতি কুদৃষ্টি যেমন ছুঁড়ে দিয়ে নিজেকে আড়াল করে ঠিক তেমনই দোষারোপ করে নিজের পশুত্ব ঢাকতে ব্যস্ত। এক্ষেত্রে সঙ্গী- সাথী তারই সমশ্রেণি! নারীর আচরণ তারা চোখে দেখে কিন্তু ধূর্ত পুরুষ রাতের আঁধারে নারীর শরীর-মন জুড়ে যে হৃদয়ের ক্ষত গড়ে তোলে ধীরে ধীরে সেখানে জাতির বিবেক চুপ! পুলিশ মামলা নেয় না, সমাজ নারীর চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তোলে এ আর নতুন কী! হ্যাঁ নারীই তাহলে দিনশেষে কারাগারের আসামি৷ তবে সেই আসামি করে তোলার আগে নারীর মনকে পুরুষ কতটুকু প্রাধান্য দিয়েছে বা দেয়? ঘরে-বাইরে নারীকে অবমূল্যায়ন করার নেশা পুরুষের ভেতর যতোটা রয়েছে তা ঠিক পশুর মধ্যেও হয়তো ততোটা নেই!

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে দিন দিন ডিভোর্সের হার বাড়ছে। গত এক বছরে ডিভোর্সের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৪ শতাংশ। যা আগের বছর ছিলো ০.৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ভবনে বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২২-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

দেশে সংসার ভেঙে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে তালাক হয়েছে। বিচ্ছেদ বেড়েছে ঢাকার বাইরেও।

রিপোর্ট অনুযায়ী, বিচ্ছেদের আবেদন নারীরা বেশি করছেন। নির্যাতন-পীড়ন থেকে আত্মমর্যাদাবান নারীরা তালাকে খুঁজছেন মুক্তি। বিচ্ছেদের আবেদনের পর সমঝোতা হয়েছে খুবই কম। ৫ শতাংশের নিচে তা।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিবাহবিচ্ছেদের এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনায় অধিকাংশই নারীকে দোষারোপ করছেন। কেউ বলছেন নারীর অতিরিক্ত স্বাধীনতার কথা, কেউবা বলছেন নারীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কথা। এই বিষয়ে নারীর ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ সমাজকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে ! অধিকাংশের মন্তব্যের জেরে মনেই হচ্ছে নারী যেন সংসার পাতেই সংসারের ভাঙন সৃষ্টি করতে!

ডিভোর্স বাড়ছে। কিন্তু ডিভোর্স কেন বাড়ছে? এই বিষয় অনুসন্ধান করা হয়েছে কি? আর ডিভোর্স হলেই নারীকে কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে? নারী কী একা সংসার করেন নাকি সেখানে পুরুষেরও উপস্থিতি আছে? তবে সংসার ভাঙা বা বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পিছনের কারণগুলো কেন সামনে আসছে না। বরং একবাক্যে নারীকে দোষী সাবস্ত করা হচ্ছে!

মূলত এটি বিবাহবিচ্ছেদের একটি কারণ হিসেবে ধরা যায়। তবে তা মুখ্য কারণ নয়। মূলত যেই নারীরা ডিভোর্সের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা নিশ্চয় হঠকারি কোনো সিদ্ধান্তে যাচ্ছেন না। এটা আগে সবার স্বীকার করা প্রয়োজন যে, নারী বা পুরুষ কেউই কিন্তু সংসার ভাঙতে চান না। তবে কেন ভাঙছে এটাই প্রশ্ন হওয়া উচিত!

সংসার বা দাম্পত্য সম্পর্কের প্রধান শর্ত ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান-মনের মিল আবশ্যক। শুধু অর্থের যোগান দিলেই সংসার টেকে না বা ঠিক থাকে না। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দেখা যায়, নিরানব্বই ভাগ পুরুষই সংসারে অর্থ জোগান দিয়ে ক্ষান্ত থাকেন। স্ত্রী-সন্তানের প্রতি তার যে কিছু দায়-দায়িত্ব থাকে সেটা তিনি অবলীলায় ভুলে যান। অন্যদিকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে দিনে দিনে নারী খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে একসময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় এবং সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে।

বিবাহবিচ্ছেদ কোনো একটি কারণে ঘটে না, এটা সবাইকে আগে মাথায় ঢুকাতে হবে। অনেক সমস্যা-সংকটকে যখন আর সমাধানের মতো অপশন না থাকে তখনই কেবল একজন নারী বা পুরুষ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিগত বছরে এমন কিছু জুটির বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা আসে যেখানে তা কল্পনাও করা যায় না! এবং এই বিচ্ছেদের মূলে যে নারীই অন্যতম ক্রীড়ানক তা সবাই স্বীকার করেন! কিন্তু সত্যিটা কি? কখনও পুরুষ সমাজ একটুও সচেতন দৃষ্টি ও গভীর মন নিয়ে ভেবে দেখেছেন সংসার ভাঙ্গন ধরে ধীরে ধীরে! কাঠ যেমন ঘুণ পোকায় খেতে থাকে মানব মনও তার ব্যতিক্রম নয়। কোনো একটি মুহূর্তেই নারী বা পুরুষ এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। তার পশ্চাতে হাজারটা কারণ থাকে। হাজারটা বঞ্চনা-অবমূল্যায়ন থাকে। যখন তার ভারটা নারীর আর বহনের মতো শক্তি থাকে না তখন সে মুক্তির আয়োজন করে! কতোটা মানসিক দীনতা, কতোটা জীবনের স্বাধীনতা হরণকারী হলে নারী সেই ভালোবাসা- সেই প্রিয় মানুষ থেকে দূরে সরার সব আয়োজন সম্পন্ন করেন কেউ কি ভাবেন!

যে ঘরে নারী তার আপন শান্তি-স্বস্তি, ভালোবাসা-মূল্যায়ন খুঁজতে থাকে সেখানে পুরুষ এক জড়বস্তু হয়ে ওঠে! যদি তা না হয় তবে এ বিশ্বে কোনো নারীই স্থান পরিত্যাগ করবে না তা হলফ করে বলা যায়। বিল গেসট ও মেলিণ্ডার ২৭ বছরের জীবনে কেউই কী তাদের এই দীর্ঘ জীবনে জোরারোপ করেছিলেন একসঙ্গে থাকতেই হবে? তাহলে ২৭ বছর আগে যা ঘটলো না তা কেন পরে ঘটলো? নিশ্চিত কারণ না থাকলে সেখানে কী সত্যি বিচ্ছেদ হয়! বিলগেটসের টাকা-সম্মান-সৌন্দর্য কিছুরই তো অভাব নাই! তাহলে নারী হৃদয়ের কী এমন অভাব বা বঞ্চনা আসলো যে ২৭ বছর পরে সে বিচ্ছেদ চাইলো! বিচ্ছেদকে কেন্দ্র করে অনেকেই রব তুলেছিলেন নারী কিসে আটকায়! হাস্যকর কথা। নারী বা পুরুষ শুধু মনের টানে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-ভালোবাসা ও মূল্যায়নে আটকায়। এর বাইরে টাকা-পয়সা-ঐশ্বর্য কোথাও তো আটকাতে দেখা যায় না৷ তাহলে যেমন সেলিব্রিটিরা ঘর ভাঙতো না, তেমনই সাধারণ মানুষও নির্বিঘ্নে ঘর করতো। আর মনের মিলে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা যে আজীবন অমলিন থাকবে এটাই বা কোন মহা মনীষী বলেছেন! আজ যা ঠিক কাল বা কিছুক্ষণ পরেই বেঠিক হতে পারে। নির্দিষ্ট কোড অফ লাইফ বলে কিছু নেই। মত-পথের প্রতি নিয়তই পরিবর্তন হয়। হবে। কারণ মানুষ জীবন সর্বস্ব প্রাণী। জড়বস্তু নয়। সম্প্রতি মাহিয়া মাহির বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আবারও জল ঘোলা হচ্ছে৷ নারীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে!

আগের যুগে এতটা বিবাহবিচ্ছেদ না থাকার কারণ তখন নারী বা পুরুষ উভয়ই লোকলজ্জাকে প্রাধান্য দিতো। অর্থাৎ তারা নিজেদের সমস্যার চেয়ে বাইরের মান-অপমানকে বেশি গায়ে মাখতো। ঘরে শান্তি না থাকলেও মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে চলার ব্রত পালন করতো। সবচেয়ে বড় কথা তখনকার মানুষের ধারণা এবং বিশ্বাসই ছিল একবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে আজীবন তাকে ভার বহন করতেই হবে। ফলে তখন এই একটি মানসিকতাই অনেক সমস্যাকে গিলে ফেলতো। স্বামী বা স্ত্রী মনে করতেন সমস্যা বাড়িয়ে লাভ নেই, আজীবন থাকতেই হবে। ফলে যেকোনোভাবে সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতেন। আবার অনেকে একসঙ্গে এক ছাদের তলায় কাটিয়ে দিয়েছেন কিন্তু আত্মিক সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। বিভিন্ন কারণ কিন্তু আছেই।

তবে বর্তমান সময়ে মানুষের মাঝে এসবের বালাই নেই। তারা নিজেদের জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। মনের অমিল, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সম্মান না থাকলে আত্মমর্যাদা খুইয়ে টিকে থাকার লড়াই করছেন না। অধিকাংশ যে টিকে থাকার লড়াই করছেন না এটাও বলা ভুল। বলে চলে করেও ফল না পেয়ে সম্পর্কের ইতি টানতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই এক্ষেত্রে নারীকে দোষারোপ করা নিষ্প্রয়োজন। কারণ পুরুষের অত্যাচার সহ্য না করে নারীরা মুক্তি খুঁজছে। সেই মুক্তির পথে আর্থিক স্বচ্ছলতা, স্বাধীনতা বিশেষভাবে সহায়ক। তবে এটা মানতেই হবে, নারীরা এখন নির্যাতনকে ‘না’ বলছেন। তা মানসিক বা শারীরিক হোক।

যৌতুক, বৈবাহিক ধর্ষণ, অসম্মান-অবহেলা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, অন্যত্র প্রেম বহুল সমস্যা থেকে বাঁচতে নারী এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। বিচ্ছেদকে যতই নেতিবাচকভাবে দেখা হোক না কেনো এখানে ইতির কিন্তু উপস্থিতি বিদ্যমান। মূলত মানুষ তার নিজেকে প্রাধান্য দিচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্যাতনে চুপটি করে বসে না থেকে প্রতিবাদ করছে। তাই বিচ্ছেদ নিয়ে শঙ্কিত হতে হলে আগে মানবিক হৃদ্যতা গড়ে তুলতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, নারীর কাজকে মূল্যায়ন, পারিবারিক দায়-দায়িত্বের প্রতি পুরুষের সহোযোগিতা করতেই হবে। নারীকে অবলা পশু ভেবে পাশবিক অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যুগ যেমন পাল্টাচ্ছে নারীরাও তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে নারীকে মানুষ হিসেবে তার পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে বর্তমান সময়ে বিচ্ছেদ কমিয়ে আনা কষ্টসাধ্য! আর সংসার টিকিয়ে রাখার দায় পুরুষ ও নারীর উভয়েরই। ফলে পাল্লার একদিক ভারী হলে সেটা ছিঁড়ে পড়বেই! তাই এতে শঙ্কিত না হয়ে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে উদ্যোগী হতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি ভালোবাসা-সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ-পারস্পারিক দায়বোধ ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই ধরণী তলে ফুলের নৈবেদ্য দিয়ে সাজবে সংসার।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ