নারীকে স্বাবলম্বী হতে দাও
বর্তমান সময়ে নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে উঠছে। নারীকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে তার লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণে। একইসঙ্গে ঘরে-বাইরে নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। তবে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতন নতুন নয় কিন্তু ইন্টারনেটের সহজলভ্য ব্যবহারের ফলে এগুলো ইদানিং খুব বেশি প্রচারিত হচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ভীতিও বাড়ছে। নারীদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতনকে রুখে দিতে হলে নারীর শক্ত অবস্থান জরুরি।
কারণ পৃথিবীর ধর্মই এই যে, বিপদের সময় বা কোন প্রয়োজনে পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। আর নারীদের জীবন তো আরও জটিল৷ কন্যা সন্তান শৈশব থেকেই যে বৈষম্যের শিকার বয়স যত বাড়ে তত এর সম্মুখীন বেশি হতে থাকে নারী৷ একটা সময় আপনজনের অভাববোধ থেকে শুরু করে জীবনের জটিলতা সবটাই একা নারীকে সামাল দিতে হয়। তারওপর বর্তমান সময়ে টালমাটাল দাম্পত্য সম্পর্ক। অবিশ্বাস – অনাস্থা – ভরসাহীনতার অভাবে অনেক সংসারেই সংকট তৈরি হতে দেখা যায়। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলেও নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার বিকল্প নেই। অর্থাৎ নারী যদি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে তবে অনেকটা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সক্ষম হয়। তাই যুগের চাহিদায় আজকাল নারীকে ঘরে আবদ্ধ থাকলে চলছে না। নারীরা যদি সমস্যাকে জিইয়ে বসে থাকেন তবে অবিশ্বম্ভাবীভাবেই তাকে গ্রাস করবে! ফলে নারীর জীবনের যাপনকে সুন্দর – সুস্থ করে তুলতে নারীকে জীবন তরী ভাসাতে জানতে হবে।
যান্ত্রিক জীবনে প্রতিনিয়তই মানুষকে পার করতে হচ্ছে কঠিন সময়। জীবন জটিলতার এক্ষণে তাই নিজের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে একধরনের আত্মিক এবং মানসিক শান্তি লাভ করা যায়। নানাবিধ সমস্যাকে নিমিষেই সমাধান করার মতো সক্ষমতা গড়ে ওঠে। আর পারিবারিক ও সামাজিক নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
একজন স্বাবলম্বী নারী নিজের জীবনকে যতটা গুছিয়ে পরিচালনা করতে পারেন, অন্যপক্ষের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই হিমশিম খেতে হয়। আর বর্তমান যুগে এসে প্রত্যেক নারীর নতুনভাবে নিজেদের নিয়ে ভাবতে হবে। জীবনকে একটু সহজ, স্বাভাবিক ও একঘেয়েমি দূর করতে নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে হবে। শুধু তাই নয় জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বাবলম্বী হলে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হয়। ফলে নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে হবে।
নারীরা স্বাবলম্বী হলে জীবনের অনেক প্রতিকূলতা থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। পরিবার থেকে নারীকে বেশ ঘরকুনো করে গড়ে তোলা হয় আজও। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে শতভাগ শিক্ষা আজও নিশ্চিত করা যায়নি। সেক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয় অনেক মেয়েকেই। স্বামীর পরিবার থেকে নিপীড়ন, অত্যাচার হলেও এই নারীদের মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। কারণ তাদের অর্থনৈতিক কোনো সহয়তা থাকে না। এছাড়া থাকে না মাথা গোঁজার মতো একটু ঠাঁই। পরিবার-পরিজনও এ সময় বন্ধন ছিন্ন করে নারীকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর মুখে! এক্ষেত্রে নারীর অর্থের যোগান থাকলে নারী নিজের বিরুদ্ধে হওয়া সব অন্যায়কে রুখে দিতে পারেন। তাছাড়া পরিবারের সদস্যদের চাহিদা পূরণ, নিজের শখের কাজ করা, বাবা-মাকে সাহায্য করা এমন বিবিধ কাজ নারী একহাতে সামলাতে পারেন, যদি নারী স্বাবলম্বী হন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক মর্যদার কথাও যদি বিবেচনা করা যায় তবে দেখা যায় স্বাবলম্বী নারীর সম্মান-শ্রদ্ধাও বেশি। তার প্রতি পরিবার ও সমাজ সমীহের চোখে দেখে। কিন্তু নারী যদি শুধু পরিবারে সময় ব্যয় করেন, সেটা পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। যদিও একজন নারী পরিবারে যতটা সময় ব্যয় করেন, তার আর্থিক মূল্য অনেক। তবু সমাজের মাঝে গড়ে ওঠা কিছু ট্যাবু আজও ভেঙে ফেলা যায়নি। সে লক্ষ্যে নারীদের পথে নামতে হবে। নারীদের চেষ্টাতে সব সম্ভব।
হয়তো কিছু কাজের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে নানারকম সমস্যা আসবে কিন্তু নারীদের সেটুকু কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে। কারণ নারীরা পৃথিবীতে জন্মেই নানরকম বৈষম্যের শিকার হয়, রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে গা বাঁচিয়ে চলতে হয়, কর্মক্ষেত্রে তাকে পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে ভালো করার তাগিদ থাকে, পরিবারে সবার মুখে হাসি-সুখ দেখতে তাকে নিজকেই খেয়াল রাখতে হয়। এই নারীরা সর্বত্র অপরের খুশি, অন্যের মঙ্গল, অন্যের তরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে দিতেই নিজে নিঃশেষ হয়ে যান। যদি নারীরা স্বাবলম্বী হন, তবে একটি সময় অন্তত নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিতে পারবেন। কারণ তখন সামর্থ্য থাকবে। সেক্ষেত্রে সময়কে আয়ত্তে আনা শিখতে হবে নারীদের।
সব নারীরাই স্বাবলম্বী হতে পারেন। যদি তিনি মনোবল এবং ইচ্ছেশক্তি নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। শুধু উচ্চশিক্ষিত হলেই যে তিনি অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দূর করতে পারেন এমন ধারণা ভুল। আজকাল নারীরা বিভিন্ন ধরনের কর্মে নিযুক্ত। বুটিক শপ, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, হোম ডেলিভারি, জুয়েলারি তৈরি, খামারি ব্যবসা, আউটসোর্সিং, পোশাক তৈরির মতো নানা কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। শুধু একটু সদিচ্ছা জাগ্রত করতে পারলেই নারীরা বদলে ফেলতে পারবে পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্য।
এর ফলে নারীরা পারিবারিকভাবে নিজেদের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। আজকে যেই পরিবারই নারীকে তার নিজ দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিমতের মূল্যায়ন করেন না, তারাই একদিন পাশে এসে দাঁড়াবেন। বাহবা জানাবেন। ফলে নারীকে নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায়-অত্যাচার-অহিংসা-নিপীড়নের মোকাবিলা করতে হলে আগে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হবে। যদি শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, তবে ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না। এক্ষেত্রে নারীদের তাই অবশ্যই নিজেকে মূল্যায়িত করতে হলে, নিজের প্রতি অন্যের সম্মান আশা করলে আগে নিজেকেই ঘুরে দাঁড়ানো শিখতে হবে। নারীর অদম্য মেধা, প্রতিভা, শক্তিতে নারীরা একদিন সব সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করে পৃথিবীকে আপন বশে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে আশা করি।
নারীরা যদি আজকের যুগে এসেও ঘরে বন্দি থেকে ভাবতে বসেন তাকে কোনো দেবদূত এসে রক্ষা করবেন তা নিতান্তই বোকামি। কারণ যান্ত্রিক যুগে সম্পর্কের মাঝে যেমন শৈথিল্য এসেছে তেমনি পরস্পরের বোঝাপড়া, হৃদ্যতায়ও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ফলে নিজের কাজ, নিজের অবস্থান নিজেকেই তৈরি করতে হবে। বুঝতে হবে জীবনের প্রতিটি পদ সমস্যাসংকুল। তাই এ পথে হাঁটতে হলে সেই শক্তি অর্জন করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করা নারীর মুক্তির অন্যতম পাথেয়। ফলে সময় এসেছে নিজের জীবনকে গুরুত্ব দেওয়ার। নারী যখন সমস্যাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন তখন সব ঘটানাই তুচ্ছ হয়ে উঠবে। চলার পথ পরিষ্কার হবে। আর এজন্য নারীকে স্বাবলম্বী হতে হবে।