১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় জান্নাতুল ফেরদৌস: অনুপ্রেরণা হোক সবার
আমাদের সমাজে নারীদের প্রতিকূলতার সীমাপরিসীমা নেই। তদুপরি নারীরা পৃথিবী জয় করার জন্য নিজেদের শ্রম-মেধা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু চলতি পথে নারীকে নানা বাধাবিঘ্ন পেরুতে হয় আজও। বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আজও নারীকে যোগ্য সম্মান দিতে নারাজ। বিভিন্ন বিষয়ে নারীকে অবরুদ্ধ করে একপ্রকার বিকৃত লালাসা পূর্ণ করে! এরমধ্যে অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। জান্নাতুল ফেরদৌসের মতো নারীরা এ সমাজের আপামর নারীর জন্য অনুসরণীয়। জীবনের কোনো বাধাই চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারে না যদি মনে শক্তি ও সাহস থাকে। আর সেই লড়াইয়ে জিতে বিবিসির তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন এই নারী।
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।
বিবিসির চলতি বছরের এ তালিকায় জান্নাতুলের সঙ্গে আরও আছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, মেয়েদের ব্যালন ডি’অরজয়ী আইতানো বনমাতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিশেষজ্ঞ টিমনিত জিবরু ও হলিউড অভিনেত্রী আমেরিকা ফেরেইরার মতো নারীরা।
প্রভাবশালী নারীর তালিকায় নাম ওঠার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জান্নাতুল ফেরদৌস গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না। বিবিসি কর্তৃপক্ষ তিন সপ্তাহ আগে জানতে চেয়েছিল, এই তালিকায় আমার নাম উঠলে আপত্তি আছে কি না। এটা খুবই খুশির খবর। এ স্বীকৃতি আমার কাজের আগ্রহ আরও বাড়বে এবং অন্যান্য কাজেও এটা সহায়তা করবে।’
১৯৯৭ সালে রান্না করার সময় জান্নাতুলের ওড়নায় আগুন লাগে। শরীরের বেশির ভাগটা পুড়ে যায়। পুড়ে–কুঁচকে বিকৃত হয় মুখ ও শরীরের একটা অংশ। এ পর্যন্ত চামড়া প্রতিস্থাপনসহ তাঁর শরীরে প্রায় ৫০ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
জান্নাতুল বলেন, ‘পোড়ার যে যন্ত্রণা, তা সারা জীবন বইতে হয়। এখনো শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগি। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়িনি। পরিবারের সার্বিক সহায়তা পেয়েছি, পাচ্ছি।’
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জান্নাতুল ফেরদৌসের শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। এরপরও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ, লেখালেখি ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।
খুলনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা জান্নাতুল নিজের যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা থেকে ২০১৫ সালে ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক। এটি দগ্ধ নারীদের সচেতন করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে।
জান্নাতুল তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনটি। তাঁর লেখা ১১টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
জান্নাতুলের জন্ম খুলনায় হলেও বাবা শরীফ জাফর আহমেদ সিদ্দিকীর বাড়ি গোপালগঞ্জে। ২০১৩ সালে বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে জান্নাতুল রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় মা মরিয়ম সিদ্দিকী, ভাই শরীফ মো. ঈসার সঙ্গে থাকছেন।
জান্নাতুল অনিয়মিত (প্রাইভেট) শিক্ষার্থী হিসেবে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন। আইনবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি আছে তাঁর। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে করেছেন মাস্টার্স। চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন কোর্সও করেছেন জান্নাতুল।
দগ্ধ শরীরের কারণে বিভিন্ন সময় নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে জান্নাতুলকে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিয়ে করেননি বলে জানালেন জান্নাতুল। বললেন, এই সমাজে বিয়ে না করে একা থাকার এ সাহস জুগিয়েছেন তাঁর মা। মা সব সময় বলে এসেছেন, শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্য বিয়ে করার প্রয়োজন নেই।
মেয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্তির বিষয়ে জানতে গতকাল মুঠোফোনে মরিয়ম সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খবরটা শুনে অনেক শান্তি লেগেছে। কিছু মানুষ মেয়েকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। তবে আমার মেয়ে অনেক মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতিও পেয়েছে।’
জান্নাতুল জানালেন, ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা আছে। তবে সেখানে দগ্ধ ব্যক্তিদের বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা নেই। তিনি এ আইনে দগ্ধ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়টিকে প্রতিবন্ধিতার আলাদা ধরন হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য কাজ করবেন।
জান্নাতুল ফেরদৌসের এই অর্জন আপামর নারীর জন্য বড় প্রেরণা হয়ে উঠেছে। জীবনের শত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে মনোবলকে সঙ্গী করে চলা আজকের যান্ত্রিক যুগে বিরলই। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, টানাপোড়েন সবকিছু মিলিয়ে মানুষ এক অবরুদ্ধ সমাজে বাস করছে। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে জান্নাতুল ফেরদৌস নারীদের জন্য নতুন পথের সন্ধান দিলেন। মনের প্রবল তাগিদের কাছে হাজার হাজার প্রস্তর খণ্ডকেও যে নিমিষে গুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব তার জীবন-সংগ্রাম, মনোবল ও পথচলাই নির্দেশ করে। শতকোটি শ্রদ্ধা হে মহীয়সী।