নারী স্থপতির নকশায় অত্যাধুনিক বিমানবন্দরের যুগে বাংলাদেশ
সোশ্যাল মিডিয়া ও টিভির কল্যাণে অনেকেই দেখছেন রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নবনির্মিত টার্মিনাল-থ্রি এর কলাম ও সিলিংয়ের আকর্ষণীয় কারুকার্যের নানা ছবি। তবে ভেতরের আংশিক ছবি দেখে পুরো স্থাপনাটির বিশালতা আন্দাজ করা কঠিন। এটি আয়তনের দিক দিয়ে যতোটা বড়, গুরুত্ব তারচেয়েও অনেকবেশি। কারণ, সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া এই টার্মিনালের মাধ্যমে আধুনিক বিমানবন্দরের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। পুরোপুরি চালু হলে এটি দেশের জন্য নতুন এক ‘আইকন’ হয়ে উঠবে অচিরেই। আর অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধা-সংবলিত এই টার্মিনালটি ডিজাইন করেছেন সিঙ্গাপুরের খ্যাতিমান নারী স্থপতি রোহানি বাহারিন। রোহানি এর আগে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টের তৃতীয় টার্মিনালসহ পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নকশা ও পরিকল্পনা করেছেন।
সাধারণত যেকোনো পেশায় কেউ যখন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন হন, ইন্টারনেটের কল্যাণে তাদের সম্পর্কে অনেককিছুই জানা যায়। তবে রোহানি তাঁর নিজ পেশায় নন্দিত হলেও প্রচার-প্রচারণার ব্যাপারে হয়তো নিজেকে গুটিয়েই রাখেন। কারণ আজকের দিনে গুগলে অনেক ঘাটাঘাটি করেও এই নারী সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। শুধু এইটুকুই তথ্য পাবেন যে, সিপিজি করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন রোহানি বাহারিন। চাঙ্গি এয়ারপোর্টের তৃতীয় টার্মিনাল ডিজাইন করার পাশাপাশি টার্মিনাল-১ ও ২ এর নবরূপদানের কাজও তিনিই করেছেন। এছাড়া চীনের উহান এয়ারপোর্ট, গুয়াংজু এয়ারপোর্ট, ভারতের আহমেদাবাদ এয়ারপোর্ট, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ এয়ারপোর্ট এবং ফুকুওকা এয়ারপোর্ট নির্মিত হয়েছে তাঁর ডিজাইনে। এ ছাড়া মরিশাস, ফিজি, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামেরর বিভিন্ন বিমানবন্দরের স্থপতি হিসেবেও রোহানি বাহারিন কাজ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে সিপিজি করপোরেশনের এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন অসংখ্য পুরস্কার জিতেছে। ব্যস, এইটুকুই!
বিমানবন্দর ডিজাইন করা বেশ জটিল। কারণ এখানে বহুমুখী ‘ফাংশন’-এর সংমিশ্রণ থাকে। যাত্রীরা এসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, এমন সুযোগসুবিধা রাখতে হয়। আলাদা-আলাদা এয়ারলাইনারের কাউন্টার ও ব্যাগেজ লোডিং এরিয়া থাকে; ওয়েটিং, ইমিগ্রেশন এবং অন্যান্য লাইফস্টাইল ফ্যাসিলিটি সন্নিবেশিত করতে হয়, পাশাপাশি অ্যারাইভাল ও ডিপার্চারের গেটগুলোও সাজাতে হয় চাহিদার অনুপাতে। টার্মিনালের ছাদের বাইরে থাকে বিমানের রাখা ও চলাচলের অ্যাপ্রন বা টারমার্ক। আর আকর্ষণীয় অন্দরসজ্জা তো আছেই। সবমিলিয়ে বড় এক কর্মযজ্ঞের কথা মাথায় রেখেই কাগজে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নকশা করতে হয় ও তা বাস্তবে রূপান্তর দিতে হয়।
এই জটিল কাজটি বারবার সফলভাবে করে চলেছেন যে নারী, তাঁর সম্পর্কে খুব বেশিকিছু জানতে না পারার আক্ষেপ রয়ে গেল। বাংলাদেশে তিনি যে কাজের নমুনা রেখে গেলেন, সেটিই বরং বিস্তারিত তুলে ধরি।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক
বিশ্বে এমন অনেক বিমানবন্দর রয়েছে যার একেকটি টার্মিনাল বাংলাদেশের গোটা বিমানবন্দরের সমান। এসব বিমানবন্দরে রয়েছে সবধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। যেখানে একজন যাত্রী সহজেই সব ধাপ অতিক্রম করে উড়োজাহাজে চড়তে পারেন। এশিয়া মহাদেশেও এমন অনেক বিমানবন্দর রয়েছে। সে বিবেচনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। তৃতীয় টার্মিনাল দিয়ে বাংলাদেশ এবার অত্যাধুনিক বিমানবন্দরের খাতায় নাম লেখাচ্ছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন এই টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো ২০১৯ সালের ২৮শে ডিসেম্বর। এরপরপরই হানা দেয় করোনা মহামারি। তবে সেসময় বিশেষ ব্যবস্থায় এই প্রকল্পের কাজ চালু রাখা হয়। টার্মিনালকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলের একটি রুটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যা একে একটি মাল্টি-মোডাল হাবে পরিণত করবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল তৈরির প্রকল্পটির মোট ব্যয় ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ৫ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ। বাকি তহবিল এসেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে। জাপানের মিৎসুবিশি, ফুজিটা ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে টার্মিনালটির নির্মাণ কাজ করেছে। এই নির্মাণ প্রতিষ্ঠনগুলোর বুর্জ খলিফার মতো স্কাইস্ক্র্যাপার নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টুইন-টাওয়ার, সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জের তাদাওয়াল টাওয়ার, কোরিয়ার ইচন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, আবুধাবিতে লাক্সারি হসপিটাল ‘ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক’ নির্মাণ করেছে স্যামস্যাং।
এই টার্মিনালটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। এর যাত্রী ধারণক্ষমতা হবে ১ কোটি ৬০ লাখ। শাহজালাল বিমানবন্দরের পুরনো দুটি টার্মিনালের ফ্লোর স্পেস ১ লাখ বর্গমিটার, যা সর্বমোট ৮০ লাখ যাত্রী ধারণ করতে পারতো। ফলে তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া যাবে বলা আশা করা হচ্ছে।
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের আগে ২০১৭ সালে নকশা ও নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট চার পক্ষের একটি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেন বেবিচকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার-ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কনসাল্টিং অপারেশন নিপ্পন কোম্পানির ভাইস-চেয়ারম্যান হারুহিকো কানাই, জাপান অরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোবাল লিমিটেডের ভাইস-চেয়ারম্যান জুন ইয়য়ামাউচি, সিপিজি করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ ভাইস-প্রেসিডেন্ট রোহানি বাহারিন এবং বাংলাদেশ ডিজাইন কনসালট্যান্ট লিমিটেডের প্রধান (প্রয়াত) একেএম রফিকুদ্দীন।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
পুরো স্থাপনাটির নকশা সিমেট্রিক্যাল বা দ্বি-পার্শ্বীয় প্রতিসম। অর্থাৎ, একে মাঝ বরাবর কাটলে উত্তর এবং দক্ষিণে প্রায় একইধরনের সুযোগ সুবিধা দেখতে পাওয়া যাবে। এভাবেই এটির কনকোর্স এ এবং বি বিভক্ত হয়েছে। ফ্যাসাদ বা বাইরের দেয়ালে ব্যবহার করা গ্লাসের কারণে টার্মিনালের ভেতর পর্যাপ্ত পরিমাণে দিনের আলো প্রবেশ করবে। এছাড়া উজ্জ্বল ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের কারণে ভেতরের পরিবেশ হবে ঝলমলে।
টার্মিনালের বাইরে সামনের অংশে থাকছে প্রশস্ত কার ড্রপ অফ, যা অনেক গাড়ির চাপ অনায়াসেই সামলে নেবে। কনকোর্সের ভেতরে ডাবল-হাইট ও ট্রিপল-হাইট স্পেস এখানে আসা যাত্রীদের দারুণ এক ওয়েলকামিং এক্সপেরিয়েন্স দেবে। এর সঙ্গে কলাম ও সিলিংয়ের বাহারি কারুকার্য তো থাকছেই।
কী কী থাকছে নতুন টার্মিনালে
তিনতলা বিশিষ্ট টার্মিনালের প্রথমতলায় থাকছে ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং সিস্টেম, ভিভিআইপি, ভিআইপি এন্ট্রান্স, ইত্যাদি। দ্বিতীয় তলায় বহির্গমন লাউঞ্জ, মুভি লাউঞ্জ, ফুড কোর্ট, কিডস জোন এবং বোর্ডিং ব্রিজ। এছাড়া তৃতীয় তলায় বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, বিদেশগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, চেক-ইন কাউন্টার ও আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধা থাকছে।
ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা করে বিশেষ ব্যবস্থাপনা থাকবে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে এই আয়োজন। ট্রানজিটে আসা যাত্রীরা প্রধান বহির্গমন লাউঞ্জ ব্যবহার করবে, যার আয়তন ৪০ হাজার বর্গ মিটার।
পুরো টার্মিনালে ৪১টি লিফট থাকছে, যারমধ্যে প্যাসেঞ্জার লিফট ৩৪টি। এছাড়া ৩৫টি এসকেলেটর ও ১৪টি মুভিং ওয়াকওয়ে থাকবে।
টার্মিনাল থ্রি-এর সঙ্গে নতুন করে তৈরি করা কার পার্কিংয়ে ১২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। এছাড়া আমদানি-রফতানি কার্গো ভবন বা এয়ারলাইন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় যা যা দরকার, সবই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে বিন্যস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নতুন টার্মিনালে মোট বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে ২৬টি, যেখানে আগের দুটি টার্মিনালে মোট ব্রিজ ছিলো ৮টি। একই সাথে নতুন টার্মিনালে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। আগের দুটিতে রাখা যেতো ২৯টি উড়োজাহাজ।
আগে লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট ছিলো দুই টার্মিনাল মিলিয়ে আটটি। এখন শুধু তৃতীয় টার্মিনালেই এ ধরনের বেল্ট আছে ১৬টি।
আগের দুটি টার্মিনালে মোট চেক-ইন কাউন্টার ছিলো ৬২টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ছিলো ১০৭টি। তৃতীয় টার্মিনালে আরও যুক্ত হয়েছে চেক ইন কাউন্টার ১১৫টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১২৮টি।
ফ্রান্সের সহায়তায় আধুনিক প্রযুক্তির রাডারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে এ টার্মিনালে । এছাড়া একটি টানেলের মাধ্যমে এই টার্মিনাল থেকে সরাসরি হজ ক্যাম্প ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সাথে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হবে। পুরনো দু’টি টার্মিনালের সঙ্গে এখন সংযোগ না থাকলেও পর্যায়ক্রমে করিডর তৈরি করা হবে।
নতুন টার্মিনাল ঘিরে প্রত্যাশার পারদ অনেক উঁচুতে
পাকিস্তান আমলে ঢাকার বিমানবন্দরের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। নকশা করা হয় ষাটের দশকে, আর নির্মাণকাজ হয় আশির দশকে। পুরনো এই বিমানবন্দরটি বেশ কয়েক বছর ধরেই যাত্রী ও উড়োজাহাজ চলাচলের চাপ সামলাতে পারছিলো না। আশা করা যাচ্ছে, নতুন অবকাঠামোর সঙ্গে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে এখন থেকে যাত্রীসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
বিমানবন্দর নির্মাণের সঙ্গে থাকা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন টার্মিনালে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারবেন। বর্তমান টার্মিনাল দুটির অধিকাংশ ব্যবস্থাপনা অনেকগুলো সনাতন পদ্ধতিতে চলে; কিন্তু নতুনটিতে সব হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এখানে যাত্রীদের জন্য ই-গেট, হাতের স্পর্শ ছাড়া চেকিং, নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন, সুপরিসর অ্যাপ্রোন, বিশাল গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত লাগেজ বেল্ট যাত্রীদের দেবে নতুন অভিজ্ঞতা।
তবে এসব সেবা পাওয়া যাবে ২০২৪ সালের শেষদিকে। এখন তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করা হলেও যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন ও ক্যালিব্রেশনের বেশকিছু কাজ বাকি, যা শেষ করতে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
দৃষ্টিনন্দন শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মধ্য দিয়ে ঢাকার আকাশপথে সম্ভাবনার নবদিগন্ত উন্মোচিত হলো। উদ্বোধনের সময় যেমনটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটিই একসময় হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক হাব।
বিমানবন্দর একটি দেশের সঙ্গে গোটা বিশ্বের সংযোগ ঘটায়। ফলে বিমানবন্দর-সংক্রান্ত কোনো আলোচনা এলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কথাও মাথায় আসে। সেসব দেশের বিমানবন্দর কেমন হয়, সেটিও অনেকের কাছে আগ্রহের বিষয়। তাই এবার চলুন দেশের বাইরের কয়েকটি বিমানবন্দর সম্পর্কে জেনে নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিমানবন্দর কোনগুলো, এমন প্রশ্ন করলে স্থাপত্যের নান্দনিকতা, বৈচিত্র্য ও সুযোগসুবিধা বিবেচনায় অনেকগুলো নাম সামনে আসে। যার কয়েকটি হল সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট, হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, বেইজিংয়ের ড্যাক্সিং এয়ারপোর্ট, মরক্কোর মারাকেশ মেনেরা এয়ারপোর্ট, দুবাই এয়ারপোর্ট, নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট, কিংবা ভারতের মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি এয়ারপোর্ট। এছাড়াও আরও অনেক বিমানবন্দর আছে যা সৌন্দর্যের দিক দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করে, তৈরি করে নিজ নিজ দেশের ‘আইকনিক ইমেজ’।
চাঙ্গি এয়ারপোর্ট, সিঙ্গাপুর
বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর একটি হল সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট। এর রয়েছে ৪টি টার্মিনাল। এখানে অন্তত ১০০টি এয়ারলাইনের বিমান ওঠানামা করে। এই বিমানবন্দরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটি হল জ্যুয়েল চাঙ্গি। এটি একসঙ্গে একটি ন্যাচার-থিমড এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড রিটেইল কমপ্লেক্স, যা এয়ারপোর্টের তিনটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইনডোর ওয়াটারফল বা জলপ্রপাত। এর নাম রেইন ভরটেক্স, যার চতুর্পাশে রয়েছে নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছ। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে ধাপে ধাপে সাজানো বিভিন্ন ধরনের বাগান, বিনোদনব্যবস্থা, একটি হোটেল, প্রায় ৩০০টি খাবারের জায়গা, এবং আর্লি ব্যাগেজ চেক-ইন সুবিধা। জুয়েল চাঙ্গি ১৪ লক্ষ ৬১ হাজার বর্গফুটজুড়ে বিস্তৃত। ১০ তলাবিশিষ্ট কমপ্লেক্সের পাঁচতলা মাটির নিচে এবং পাঁচতলা মাটির ওপরে। প্রতিদিন এখানে ৩ লাখ মানুষ আসাযাওয়া করে।
এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম ইনডোর গার্ডেন শিসেইডো ফরেস্ট ভ্যালির অবস্থানও জুয়েল চাঙ্গিতে। এছাড়া কমপ্লেক্সের ওপরের অংশে রয়েছে সুসজ্জিত ক্যানোপি পার্ক। পুরো কমপ্লেক্সটি যেন অন্য এক জগত। জুয়েল চাঙ্গির গোলাকার গ্লাস ও স্টিল ফ্যাসাদ ডিজাইনের সঙ্গে বহু স্থপতির সম্পৃক্ততা ছিল, যাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মোশে স্যাফদি। এশিয়া-প্যাসিফিকের গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইং হাব হিসেবে নিজেদের শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতেই সিঙ্গাপুর এমন অত্যাধুনিক স্থাপত্য গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জুয়েল চাঙ্গি মূলত বৃহৎ চাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ওয়ানের পুরনো কার-পার্কিং এরিয়ার ওপর নির্মিত হয়েছে। এতে যেমন যাত্রীধারণ ক্ষমতাও বেড়েছে, তেমনি দৃষ্টিনন্দন পরিবেশের পাশাপাশি যোগ হয়েছে বাড়তি নানা সুবিধা। ২০১৯ সালে কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে এটি একটি ‘আইকন’ হিসেবে রূপ নিয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই চাঙ্গি এয়ারপোর্টেরই তৃতীয় টার্মিনাল ডিজাইন করেছেন স্থপতি রোহানি বাহারিন।
ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দর
ওরিয়েন্টাল এবং ইউরোপিয় ধাঁচের সংমিশ্রণে এই বিমানবন্দরটি তুরস্ক ও ইস্তাম্বুলের ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ স্থাপত্যরীতির প্রতিফলন ঘটায় ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দর। ভল্ট আকৃতির ছাদ , এবং ওপরে মাঝে বৃত্তাকার খোলা অংশ দিয়ে বাইরের আলোর প্রবেশ –এই বিষয়টি বিমানবন্দরে ঢোকার দারুণ এক অভিজ্ঞতা দেয়।
কৃষ্ণসাগরের তীরে, ইস্তাম্বুল শহরের ৩৫ কিলোমিটার দূরে এই বিমানবন্দরের অবস্থান। স্থাপত্য নকশা করেছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান গ্রিম-শ আর্কিটেক্টস এবং নরওয়ের হাপটিক আর্কিটেক্টস। নরডিক অ্যান্ড পার্টনারস এর কনসেপচুয়াল ডিজাইনে যুক্ত ছিল। ডিটেল ডিজাইনে কাজ করেছে ফংকসিয়ন ও টিএএম/কিক্লপ।
প্রতিবছর ৯০ কোটি যাত্রী আসাযাওয়া করে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের বিশাল টার্মিনালে। এখানে ৩টি মূল ও ২টি ব্যাকআপ রানওয়ে রয়েছে।
চারটি ফেজে এই বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। উন্নয়নকাজ শেষ হলে বিমানবন্দরটি বছরে অন্তত ১৫ কোটি যাত্রীকে সেবা দিতে পারবে। ২০২৭ সালে যখন এই বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ সম্পূর্ণরূপে শেষ হবে, তখন এতে ৮টি রানওয়ে থাকবে। ৭ কোটি বর্গফুটের অ্যাপ্রন থাকবে যেখানে পার্ক করা যাবে ৫০০টি বিমান। পুরো একটি এয়ারপোর্ট সিটি তৈরির মাধ্যমে সন্নিবেশিত করা হবে ইনডোর-আউটডোর মিলিয়ে ৭০ হাজার গাড়ির পার্কিং, একটি হোটেল, কনভেনশন সেন্টার ও অন্যান্য লাইফস্টাইল ফ্যাসিলিটি।
বাহরাইন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
মধ্যপ্রাচ্যের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র বাহরাইন। দেশটি পারস্য উপসাগরের পশ্চিম অংশের ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর একটি মুহাররাক দ্বীপ, যেখানে অবস্থিত বাহরাইন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো বিমানবন্দর, যা ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২১ সালে নতুনরূপে যাত্রা করে বিমানবন্দরটি। পুরনো টার্মিনালকে প্রায় চারগুণ সম্প্রসারণ করে গড়ে উঠেছে নতুন টার্মিনাল। আগামী তিন দশকের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা বাড়ার কথা বিবেচনা করে এর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন বছরে পৌনে ৩ কোটি যাত্রী ধারণ করতে সক্ষম বিমানবন্দরটি।
বাহরাইনের বাণিজ্য ও পর্যটন বেশ সমৃদ্ধ। ফলে পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে একধরনের ‘গ্র্যান্ড এন্ট্রি’ তৈরির প্রয়োজনীয়তা থেকেই বিমানবন্দরটি ঢেলে সাজানো হয়েছে। ‘বাহরাইনি স্যান্ড অ্যান্ড স্কাই’-এর সঙ্গে মিল রেখে ম্যাটেরিয়াল কালার ও শেপ নির্ধারণ করা হয়েছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠের সিলিন্ডার ও ল্যুভর।
প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবনটি টেকসই ও সবুজ স্থাপনা নির্মাণের বিভিন্ন দিক অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। এনার্জি এফিশিয়েন্সির ফলে এটি লিডারশীপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন বা লিডের গোল্ড সার্টিফিকেট লাভ করেছে। এটিই বাহরাইনের বৃহত্তম গ্রিন বিল্ডিং। এছাড়া এতে অন্যান্য সকল বিমানবন্দরের মতো প্রয়োজনীয় সব সুযোগসুবিধা ও যাত্রী পরিষেবা তো থাকছেই।