নারীর কাজের মূল্য দেবে কবে
আমাদের সমাজে আজও নারীর কাজের মূল্যায়ন করা হয় না। রাতদিন পরিশ্রম করলেও নারীর প্রতি পরিবারের সদস্যদের শ্রদ্ধাবোধেরজায়গাটা নেই। তারা ভাবেন বা বিশ্বাস করেন, মা বা পরিবারের যিনি কর্ত্রী তার দায়িত্বই হচ্ছে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করা। অন্যদের জন্য নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দেওয়া। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকেই সৃষ্টি হয় নারীর অক্লান্ত রজনীর গল্প। আমরা জানি, প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অন্যতম জরুরি তার কর্মঘণ্টা৷ ও কাজের যথাযথ মূল্যায়ন। কারণ পরিশ্রম করতে করতে একসময় মানুষের ক্লান্তি আসে। জীবনটা ভারবাহী মনে হয়। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, এ সমাজে ছোট-বড় সব পেশাজীবীর কিছুটা কর্মবিরতি থাকলেও একমাত্র নারীর জন্য তা নেই। শুধু তাই নয় নেই তার কাজের প্রতি কোন সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও মূল্যায়ন! আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যে সমাজে নারী একটি পরিবারের প্রধান চালিকাশক্তি। পুরুষ শুধু টাকা যোগান দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন। তার আর কোনো দায়-দায়িত্ব তেমন চোখে পড়েই না। আর নারীর ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। নারীর কোনো অবসর নেই। তার ক্লান্তি নেই। জ্বর-জ্বালা নেই! নারী যেন রোবট সদৃশ।
নারী হলে তার ব্যথা থাকতে নেই। তার কষ্ট পেতে নেই। তার ক্লান্তি তো থাকতেই নেই। আর অবসর এ শব্দটি নারীর জন্য নয়। কারণ এ সমাজের আপাদমস্তক পুরুষ সমাজ নারীকে ভাবেন তাদের কৃতদাসী। বিয়ে করে সংসারে আনার পর নারীর কাঁধে ঝুলিয়ে দেন ওই পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব। সংসার গোছানো, সন্তান প্রতিপালন, আত্মীয়তা রক্ষা সবটা একা নারীকে সামলাতে হয়৷ নারী যেন ঠিক দশভূজা। নারীরা এ সমাজে এগুলো আবহমানকাল থেকে করেও আসছেন। কিন্তু নারীদেরও তো শরীর খারাপ আছে। তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা আছে৷ স্বামী বা সন্তান কেউই তো পরিবারের অক্লান্ত পরিশ্রম করা নারীটির প্রতি একটু মানবিক হোন না।
এমনকি প্রচণ্ড শরীর খারাপ হলেও নারীকে ভাতের হাড়ি নিয়ে বেরুতে হয়। সংসারের সবটা সামলাতে হয়। যেখানে একজন পুরুষ অসুস্থ থাকলে নারীটি দিবারাত্র সেবা-যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুলতে চান দ্রুত সেখানে নারীর জন্য থাকে পুরুষের শূন্য উপস্থিতি। এ সমাজের পুরুষরা মনে করেন নারীর কোনো সমস্যা হতে পারে না। ঘরের বউ মানে সে চাবি দেওয়া যন্ত্র। একবার বিয়ের মাধ্যমে যে যন্ত্রটিকে চালু করা হয়েছে মৃত্যুর আগে তা বন্ধ হতে পারবেই না।
পুরুষ যেখানে অসুস্থ থাকলে সংসারের ভার নারীর ওপর চলে আসে এবং স্ত্রী খুব দায়িত্ব এবং যত্নে তার সর্বোচ্চ দিয়ে সংসারিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। বছরের পর বছর বিছানাগত স্বামীকে বহন করেন৷ সেখানে দুই দিন থেকে দু মাস বউ অসুস্থ হলেই তাকে যাচ্ছেতাই কথা শুনতে হয়। বেশিরভাগ পুরুষ বিপরীত অপশন খুঁচতে চেষ্টা করেন। এমনকি এমনও আছে বউ অসুস্থ বলে আরেকটা বিয়ে করে বসে থাকেন পুরুষেরা।
যেই নারীরা বাইরে কাজ করেন অর্থাৎ চাকুরী করেন সেই নারীদের জীবন আরও দুর্বিষহ। ঘরে-বাইরে সামলে তার জীবন ওষ্ঠাগত। টাকার ভাগ কিন্তু স্বামী বা পরিবার ছাড়ে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। নারী তার নিজের জন্য শখ করে লজেন্স কিনে খাওয়ারও ইচ্ছে ব্যক্ত করেন না। অনেকেই এ মন্তব্যের বিপরীত ভাবতেই পারেন। কিন্তু কয়েকজন নারী ইচ্ছে প্রকাশ – স্বাধীন জীবন এবং ভাবনা দিয়ে গোটা নারী সমাজকে মাপা যায় না। শহরে এবং গ্রামে অধিকাংশ নারী যান্ত্রিক জীবন পার করছে। নিজের স্বপ্ন-ইচ্ছে বিলিয়ে দিয়ে স্বামী-সন্তান এবং পরিবারের সুখ কিনতে ব্যস্ত। কিন্তু দিনশেষে ওই নারীকে কেউ জিজ্ঞেস করেন না, তার ক্লান্তি আসছে কিনা। একটু অবসরের দরকার কিনা! সপ্তাহের অন্তত একটি বা দুটি দিনের দায়িত্ব পুরোপুরি পুরুষ নেবেন কিনা!
এই ভাবনা এ সমাজে অনেকটা অলীক কল্পনা। যেখানে নারীকে মানুষ মনে করা হয় না সেখানে কিভাবে মানবিক হওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে। সারাজীবন বিলিয়ে দিয়ে নারীটি অসুস্থ হয়ে যান তখন তাকে সবাই মিলে অবজ্ঞা করা শুরু হয়। যে যেমন পারে কথ্য-অকথ্য সব কথায় বলেন। আর নিরুপায়, অসহায় নারীটিকে তা সহ্য করতে হয়।
কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো, প্রতিদিন পরিবারের কাজটা যদি সমানভাগে ভাগ করে নেওয়া যায় তবে দুজনের সুসম্পর্ক যেমন বজায় থাকে তেমনই শ্রদ্ধাবোধও বেড়ে যায়। দিনশেষে ভালোবাসা প্রকাশের আর কী-বা মাধ্যম প্রয়োজন হতে পারে!
পরিবারের সব দায় একজনের ওপর দিয়ে তাকে পিষে মেরে ফেলার পায়তারা করা কতটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! সে বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ মাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন। নারীর প্রতি মানবিক হওয়া ছাড়া এ সমাজ- সংসারের অবক্ষয় কমবে না। নারীর জন্যও কর্মঘণ্টা সৃষ্টি করতে হবে।
সূর্যদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ঘুম ভাঙে। এরপর থেকে শুরু হয় পরিবারের সবার খাবার প্রস্তুত করা, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, অভিভাবকদের খাবার দেওয়া, ওষুধ দেওয়া সবটা কাজ। এমনকি সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজটাও নারীরওপর বর্তায়। আর পুরুষ কী করে ভাবুন তো! অধিকাংশ পুরুষ রান্নার ধারের কাছেও ঘেঁষেন না। সন্তানের পড়াশোনা – স্কুলের কোনো তদারকি করেন না। বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়া সবটা দায় ছেড়ে দেন বউয়ের ওপর। যাকে তিনি দাসী করে এনেছেন। একেবারে পার্মানেন্ট দাসী। যত ইচ্ছে চেপে-চুপে তাকে ছিবড়ের মতো শুষে নেন। কোথায় সম্মান আর কোথায় ভালোবাসা?
যদি একটু ভিন্নভাবে ভাবতে পারতো এ সমাজ। বউ ঘরের সৌন্দর্য। তাকে যত্ন করে আগলে রাখতে হয়। ভালোবেসে-শ্রদ্ধা দিয়ে অর্জন করতে হয়। বিয়ে নামক পার্মানেন্ট বিছানার সঙ্গী, বাড়ির দাসী নয় বরং বউয়ের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চেতনাগত পরিবর্তন যদি হতো তবে অনেক সমস্যা এ সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় নিতো। ঘরের কাজ শুধু নারীর নয় বরং পুরুষেরও এটা যদি পুরুষ বিশ্বাস করতো তবে কতোই না সুন্দর পৃথিবী হতো।
সংসারে নারীর অবসর নেই। তার কর্মঘণ্টা নেই। তিনি দিবারাত্র প্রাণ দিয়ে পরিবারকে আগলে রাখবেন। আর সবাই তার ওপর যতটা সম্ভব চাপিয়ে দিয়ে বিন্দাস জীবন কাটাতে থাকেন।
এ সমাজের অধিকাংশ পুরুষ বাইরে চাকরি- ব্যবসা বা কর্মের জন্য যাই করেন না কেন বাড়িতে তিনি পুরো ফুলবাবু। বাসায় আসেন বিশ্রামের তাগিদে। আর নারী বাইরে কাজ করলে ঠিক আছে সেটা তার উপার্জন, বিশ্রাম। বাড়িতে ফিরে সন্তান-সংসার গুছিয়ে ঠিক মতো পরিচালনা করা দায়িত্ব । তার বিশ্রাম নেই। এমনকি সরকারি চাকরিতে ছুটির দিনটাতে আত্মীয়স্বজন- বন্ধুবান্ধব- পরিবারের জন্য বাড়তি রান্না- যত্ন করার রেওয়াজ কম নয়। তাহলে নারীর জন্য কী অবশিষ্ট থাকছে!
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপে নারীর কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নয়। সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এমনকি রাতে তৃষ্ণা পেলেও বউকে উঠে পানি এনে পান করাতে হয়! অধিকাংশ ঘরের চিত্র এই। কবে এর পরিবর্তন হবে? নারীরা কবে একটু মানুষের মতো জীবন পাবে? আর কতদিন নারীদের যন্ত্র ভাবা হবে! আর কতদিন নারীর প্রতি অমানবিক অত্যাচার চলবে! নারীর কর্মপণ্টা কি নির্ধারণ করা উচিত নয়? বিশ্রামের জন্য নারীকে অবসর দেওয়া উচিত নয়! পরিবারের কাজটা দুভাগ করে নেওয়া উচিত নয়! সংসার স্বামী-স্ত্রীর কিন্তু শুধু স্ত্রীকেই কেনো জীবনপাত করতে হবে সংসার-পরিবারের জন্য! এবার একটু নারীকে নিয়ে ভাবতে শিখুন৷ মানবিক দৃষ্টও দিয়ে ভাবুন তিনিও ক্লান্ত হতে পারেন। আসুন নারীর প্রতি একটু মানবিক হই। পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে কাজ করার অভ্যেস গড়ে তুলুন। তাতে সংসার-সন্তান- পরিবারে সোনা ফলবে। নারীর কর্মঘন্টা ঠিক করার পাশাপাশি নারীর কাজের মূল্যায়ন হোক। তখনই মূল্যায়ন হবে যখন নারী অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে না দেবে। পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে নিজেকে নিঃশেষ করে দেবে! নারীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান সৃষ্টি হোক। নারী বাঁচুক, সমাজ তথা দেশের কল্যাণ হোক।