Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই

ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সংযোগ অনেকে অস্বীকার করতেই পারেন। কিন্তু ভার্চুয়াল জগৎই আমাদের ব্যক্তিত্ব, নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য; এমনকি নিজের প্রতিষ্ঠার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু ভার্চুয়াল জগৎটি অদ্ভুত নানা কারণে। এখানে ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখা যায়। লুকোচুরি খেলার মাধ্যমে অনেকেই তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু যখন ব্যক্তিকে আঘাত করে, তখন বাধে বিপত্তি। সাইবার বুলিং তেমনি একটি বিষয়। 

বুলিং শব্দটি পশ্চিমা। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে র‍্যাগিং হয়ে থাকে। বুলিংকে অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের  র‍্যাগিংয়ের সঙ্গে তুলনা করে বোঝা যেতে পারে। কিন্তু সাইবার বুলিংয়ের অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। অনলাইনে কেউ যদি অন্য ব্যক্তির দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হন, তাহলেই তিনি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। আমাদের দেশে পশ্চিমা বুলিং আস্তে আস্তে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সাইবার বুলিং দেশে অনেক আগে থেকেই আছে। সাইবার বুলিং করার ক্ষেত্রে নারীই প্রধান শিকার।  সমাজে নারী সম্পর্কে সনাতন যে ধারণা রয়েছে, সেটি থেকেই নারীর পোশাক, সিদ্ধান্ত, তার সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক অবস্থান, সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার একান্ত সিদ্ধান্ত, প্রেমবিষয়ক প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে স্বার্থপরতা পর্যন্ত জড়িয়ে থাকে। 

আলোচনার আগে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। খুবই পরিচিত ঘটনা। নাটোরের বলারিপাড়া এলাকার ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় কলেজ-শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের (৪১) মরদেহ। নিহত শিক্ষিকার স্বামী মামুন হোসেন (২৩) দাবি করেছেন তার স্ত্রী সিলিং ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনার পর স্বামী মামুন হোসেনকে পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে যায়। নিহত খায়রুন নাহার নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার একটি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। তার স্বামী মামুন হোসেন ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। অসম বিয়ে দেশে অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে স্বামী বেশি বয়সের হলে মানানসই। নারীর ক্ষেত্রে না। তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনে গণমাধ্যমে মনোযোগ পড়ে। সঙ্গত কারণেই খবর ফেসবুকে চাউর হয়। 

পশ্চিমা দেশের অনেক সংবাদমাধ্যমের মতো আমাদের গণমাধ্যমের  পেশাদারিত্বের অভাব ছিল। প্রথমত এই দম্পতির জীবন পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেয় সারা দেশের কাছে।  পেশাদার জায়গা থেকে এই দম্পতির ব্যক্তিগত জীবনের দায় তারা নেয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রশংসা করলেও অধিকাংশই নোংরা মন্তব্য করেছে। এখন খায়রুন নাহার বা তার স্বামী হয়তো বিষয়টি এত পাত্তা দেয়নি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ শুধু পোস্ট পড়ে না। কমেন্টও পড়ে। অনেক সময় গুছিয়ে লিখতে পারেন সে যুক্তি বা সনাতনী সামাজিক সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করে কমেন্ট করেন। এই কমেন্টকে ধরে আরও কমেন্ট হয়। খায়রুন নাহারের আশপাশের অনেকে যে এমন কমেন্ট দেখে প্রভাবিত হয়ে খায়রুন নাহার সম্পর্কে মানসিক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল তা স্পষ্ট। মানসিকভাবে তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন মানুষের চাহনি দেখে।

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চলতি বছর তীব্র দাবদাহে দেশ যখন পুড়ছে তখন আচমকা একজন নারীকে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রুচিহীন মন্তব্য, পোস্ট আপলোড হয়েছে। এগুলো জানা কথাই। এমনকি অনেক অনলাইন শপও সূক্ষ্মভাবে খোঁচা দিয়ে পোস্ট করেছে। আপাতদৃষ্টে নিরীহ হলেও এগুলো এক ধরনের সাইবার বুলিং। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বদৌলতে আমরা এখন সবার সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু বাস্তবে সাক্ষাতের অনুভূতি নেই। তাই সোজাসাপটা অনেক বাজে কথা বলা যায়। বান্ধবী বাদই দেওয়া হলো। অপরিচিত অনেককেই সাইবার বুলিং করা হয়। সাইবার বুলিং করার ক্ষেত্রে নারীকে সূক্ষ্ম আদিরসাত্মক মন্তব্য, বডি শেমিং, ধর্মীয় উগ্রবাদী মন্তব্য নিয়ে নানাভাবে অপমান করা হয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অনলাইনে নারীকে সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়। 

লিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে (পিসিএসডব্লিউ) আসা অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ছবি ও পরিচয় গোপন করে ভুয়া আইডি খুলে ভুক্তভোগীর ছবি, ভিডিও ও তথ্য প্রকাশ করে, এ রকম অভিযোগ এসেছে ৪৩ শতাংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাক, পাসওয়ার্ড চুরি করে অ্যাকাউন্টের দখল নেওয়া, এ রকম অভিযোগ ১৩ শতাংশ, পূর্বপরিচয় বা সম্পর্কের জের ধরে অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রকাশের হুমকি দিয়ে টাকা বা সুবিধা আদায় করার অভিযোগ ১৭ শতাংশ। মুঠোফোনে কল করে বা খুদে বার্তা পাঠিয়ে হয়রানি ১০ শতাংশ; বিভিন্ন মাধ্যমে অশ্লীল শব্দ, লেখা, ছবি বা ভিডিও হয়রানির অভিযোগ ৯ শতাংশ। এর বাইরে অন্যান্য অভিযোগ রয়েছে আরও ৮ শতাংশ। সাইবার বুলিংয়ে সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হন নারীরা। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর পিসিএসডব্লিউ যাত্রা শুরু করে। তখন থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২ বছরে ২১ হাজার ৯৪১ নারী এই সংস্থার কাছে হয়রানির অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭ হাজার ৮৮৯টি অভিযোগ এসেছে। অর্থাৎ গড়ে মাসে ৭৮৯টি অভিযোগ।

 ২০২২ সালে আরেকটি রিপোর্টে জানা যায়, ৯৯৯–এর উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির অভিযোগের পূর্বের চার বছরের কল বিশ্লেষণে দেখা যায়, দিন দিন এমন ঘটনা বেড়ে চলেছে। এই জরুরি নম্বরে ২০১৮ সালে ৬৯২টি, ২০১৯ সালে ৭৩৭টি, ২০২০ সালে ৮৯৫টি এবং ২০২১ সালে ১ হাজার ৭১টি কল এসেছিল। ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৯ মাসে এসেছে ১ হাজার ৪৪৪টি কল। অর্থাৎ মাসে গড়ে ১৪১টি অভিযোগ। অর্থাৎ সাইবার বুলিং দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও বেড়ে গেছে।

এগুলো পরিসংখ্যান। তবে আমাদের দেশে সাইবার বুলিং বিষয়টি সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হয়নি। ফলে সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাইবার অপরাধ দূর করতে সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে। সাইবার নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও বিচারের উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয় তথ্য ও প্রযুক্তি আইন, যা ২০১৩ সালে আবার সংশোধন করা হয়েছে। ২০১২ সালের পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে পর্নগ্রাফি বহন, বিনিময়, মুঠোফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করা, বিক্রি প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০১৩ সালে সাইবার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়। সাইবার বুলিংয়ের অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ডিজিটাল আইন-২০১৮–তে। যদিও ডিজিটাল আইনে পরিবর্তন এসেছে এবং সাইবার বুলিং করার ক্ষেত্রে বিচারের বিষয়টিতেও পরিবর্তন আসবে। 

মূল সমস্যা অন্যখানে। শক্ত আইন থাকার পরও প্রতিনিয়ত নারীকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। ফেসবুকে কিছু আপলোড করলে অনেকে অরুচিকর মন্তব্য শুরু করে। কেউ চেহারা নিয়ে মন্তব্য করে। আবার অনেকে ধর্মীয় ভাবনা থেকে কিছু জ্ঞান দেন। নারীকে ইনবক্সে অনেকে সেক্সচ্যাটের অফার দেন। অনেক সময় নারীর অনেক গোপনীয় ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সম্পর্কে ভেঙে গেলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছবি ছড়িয়ে দেয়। এসবকিছুই সাইবার বুলিং। সমস্যা হলো, আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাইবার বুলিং বলতে কি বোঝায় এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। উত্তর আমেরিকায় একটি গবেষণা হয়। সেখানে জানা যায়, তরুণ-তরুণীদের আত্নহত্যাপ্রবণতা অনেক বেড়েছে সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে। আমাদের দেশে এখনও সাইবার বুলিংয়ের ফলে যে সমস্যা হয় তার জন্য বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হয়নি। এজন্য আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার বুলিং বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। 

কিন্তু তা বলে থেমে থাকা যাবে না। সমাজের ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কঠিন কিছু নয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের  ক্ষেত্রে সরকার নানা পরিকল্পনা নিয়েছিল। ওরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে এখন অনেকটাই সফলতা পাওয়া গেছে। সাইবার বুলিং করার ক্ষেত্রে তা করা যাবে না কেন? অনলাইনে নারীকে সাইবার বুলিং থেকে রক্ষা করতে পারে মানুষই। দুঃখের বিষয়, দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রের মনেও বদ্ধ কুসংস্কার। নীতিমালা দিয়ে পুরো সমাজকে রাতারাতি বদলানো যাবে না। সাইবার বুলিং হলে আইনি কী কী সাহায্য নেওয়া যায় এর প্রচার-প্রচারণা জরুরি। পরবর্তী প্রজন্মকেও এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এখন অনলাইনের বদলে অল্প বয়সেই অনেক কিছু নিজে নিজে শেখা যায়। তাই সাইবার বুলিং থামাতে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের সমন্বয়ের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচলিত আইন ব্যবহার করতে হবে। বিশেষত ফেসবুকের সঙ্গে সমন্বয় করে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যাবে। 

তথ্য প্রযুক্তির যুগে সাইবার বুলিং সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভার্চুয়াল জগতে অনলাইনের মাধ্যমে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কুরুচিপূর্ণ কথা বলে মানসিক ও সামাজিকভাবে কাউকে আঘাত করাই হলো সাইবার বুলিং। এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে নারীদের ক্ষেত্রে। দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীরাই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। গত বছর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পেজ থেকে ৭৩ জন ছাত্রীর ছবিসহ আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে দেওয়া বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে নারীকে প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করা হয়। এতে নারীরা যেমন সামাজিক সম্মান হারায়, তেমনি বেঁচে থাকার শক্তিও হারায়। অনেকেই আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। বুলিং নারীদের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বুলিং শুরু হয় কোনো কিছু না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, হিংসা ও ঘৃণ্য মনুষ্যত্ব থেকে। আমি মনে করি বুলিং কমাতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যজোটই যথেষ্ট নয়, প্রশাসনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োজন। তার আগে প্রয়োজন পরিবারের সচেতন হওয়া। ভিকটিমের চুপ থাকাটাই বড় ক্ষতির কারণ।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ