মিশরে নিকাব নিষিদ্ধ: আমাদেরও অনুসরণ করা উচিত
স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। পড়াশোনা বা জ্ঞান চর্চার ফলে মগজের কলুষতা দূর হয়। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম প্রতিষ্ঠান শিক্ষালয়। কিন্তু মস্তিষ্কের কলুষতা জিইয়ে রেখে গোঁড়ামি করে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে দূরে থাকার অর্থ ভণ্ডামি করা। মিশরের মতো ধর্মপ্রধান রাষ্ট্রে নতুনভাবে নিকাব নিষিদ্ধ করেছে। এর ফলে ছাত্রীরা অন্তত তাদের স্বাধীন জীবনযাপন খানিক হলেও পাবে।
আমরা জানি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে ধর্মকে উপজীব্য করে নারীদের অবরুদ্ধ করার পায়তারা করছে সেখানে মিশরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সত্যি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। এর কারণ, যুগের সঙ্গে তাল মিলানোর কথা বাদ দিলেও মানুষের আইডেন্টিটি বলে একটি রাষ্ট্রের বিবিধ নিয়ম-নীতি রয়েছে। দেশের জনগণকে নিরাপদ রাখতে দেশের নাগরিকদের চিহ্নিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি দেশের নাগরিকদের প্রকৃত পরিচয় উন্মোচিত না হয় তবে সে দেশের প্রত্যেকটি জনগণই ঝুঁকিতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সময়ে যেভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে, ধর্ম রক্ষার নামে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে এই সিদ্ধান্তের জন্য মিশরীয় সরকার ও জনগণকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়েও বর্তমানে যেভাবে বাংলাদেশ ও মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলো নেকাব, হিজাব বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছে বা অধিকাংশ হিজাব, নেকাবকে প্রাধান্য দিচ্ছে সেখানে মিশরীয়দের এমন সিদ্ধান্তে আমাদেরও ভাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় সনাক্ত করতে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখা শতভাগ উচিত। এর বাইরে কোনো দেশের ভেতরেই তার নাগরিকদের চলাচল করা উচিত নয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী জানা যায়, মিশরের স্কুলে নিকাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বোরখার যে অংশটি মহিলাদের চেহারা ঢেকে রাখে, সেটিকেই নিকাব বলা হয়। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হতে চলা নয়া শিক্ষাবর্ষ থেকেই কার্যকর হবে এই নিষেধাজ্ঞা। মিশরের শিক্ষামন্ত্রী রেদা হেগাজি সরকারের পক্ষ থেকে নিকাব নিষিদ্ধ করার ঘোষণা করেন।
নিকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও হিজাব পরে ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারবেন। অর্থাৎ, রীতি অনুযায়ী, ছাত্রীদের চুল ঢেকে রাখার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। এদিকে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘কোনও ছাত্রী হিসাব পরবে কি পরবে না, তা যেন তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হয়। বাবা-মায়ের সেই সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত থাকা উচিত। ছাত্রীকে কোনও কিছু করতে যেন বাধ্য না করা হয়।’ সম্প্রতিকালে ভারতের কনার্টক থেকে নেকাব ও হিজাব বিতর্কের পর মিশর প্রথম এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে দিয়ে তারা যেমন নারীদের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে ঠিক তেমনই ছাত্রীদের পরিচয় সনাক্ত করার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুদিন আগে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, এই ছাত্রীদের প্রত্যেকেই চোখ, মুখ, নাক-মোড়া। যার মধ্য দিয়ে বোঝার ক্ষমতাই হয় না তারা আদৌও নারী না পুরুষ, না প্রকৃতার্থেই এদেশের নাগরিক! তাদের মুখমণ্ডল এভাবে আবৃত থাকার কারণে কোনভাবেই তাদের প্রকৃত পরিচয় সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশিত নয়! জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদেরও মিশরের মতো বিধান করা বাঞ্ছনীয়। ধর্ম রক্ষার নামে কোনো ধরনের ভাঁড়ামি দেশের জন্য মঙ্গলকর নয়। যুগের প্রেক্ষিতে, মানব সমাজের নিরাপত্তার স্বার্থে মগজের দৈন্য দূর করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না করে নারীদের অবরুদ্ধ করতে যেভাবে তাদের মাথায় ভুল তথ্য পুরে দেওয়া হচ্ছে তা ভবিষ্যৎ জাতির জন্য হুমকির!
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিনে দিনে যেভাবে ধর্মের নামে নারীদের অবরুদ্ধ জীবনযাপন শেখানো হচ্ছে বা বাধা প্রয়োগ করা হচ্ছে না তা জাতির জন্য হুমকির। জাতিকে গ্রাস করতে হলে পশ্চাৎপদ মনোভাবই যথেষ্ট! আর আমাদের নারী সমাজ এই পশ্চাৎপদ চিন্তাকে আঁকড়ে ধরেছে আপন ভেবে! কিন্তু মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখার সঙ্গে পর্দার কিসের বিরোধ! এবং পর্দা করেই সমাজে টিকতে হবে এমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পেছনেই বা কারণ কী! দিনে দিনে যেখানে পৃথিবী এগিয়ে চলেছে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের এসব দেশে নারীদের আরও ঘর বন্দি করা হচ্ছে! নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের অবরুদ্ধ করে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করছে!
মিশরের মতো আমাদের দেশের আপামর জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। এলক্ষে সরকার ও প্রশাসনের কোঠোর হতে হবে। যদি সত্যি কেউ পুরুষতান্ত্রিকতাকে জিইয়ে রাখতে চায় তবে তাদের শিক্ষার যেমন দরকার নেই তেমনই এ রাষ্ট্রে বসবাসও করার দরকার নেই। কারণ রাষ্ট্রে বাস করতে হলে রাষ্ট্রের বিধান মানতে হবে। আর সাধারণের নিরাপত্তা দিতে স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নেকাব নিষিদ্ধ করতে হবে। তা নাহলে অদূর ভবিষ্যতে জাতির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হবে। ভীতির সৃষ্টি হবে! জঙ্গি সংগঠন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেও শঙ্কাবোধ করবে না! মিশরের এই নীতি ধর্মকে উপজীব্য করে চলা শক্তিশালী দেশগুলোকেও অনুসরণ করা জরুরি। এতে কারোরই কোনো স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ হবে না কারণ মুখমণ্ডলটাই কেবল উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে এখানে। নারীরা মুক্তি পাক। তাদের ভেতরকার পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বিসর্জন দেওয়ার ক্ষমতা গড়ে উঠুক। তবেই প্রকৃত মুক্তি ঘটবে।