ছাব্বিশ বছরেও ইয়াসমিনদের মুক্তি মিললো না!
ইদানীং সমাজে ঘটে যাওয়া নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দিকে লক্ষ করলে সহজেই অনুমেয় যে, নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। পরিবার, গণ-পরিবহনে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় কোথাও নারী নিরাপদ নয়। ঘর থেকে নারীর প্রতি যে ধরনের অন্যায়-অবিচার শুরু হয় তাই দীর্ঘ হতে থাকে। ঘরের বাইরে নারী আজও অনিরাপদ। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, নারীর অগ্রযাত্রা বাড়লেও চলার পথে প্রতিবন্ধকতা কম নয়। তবু নারীরা তাদের মনোবলকে সঙ্গী করে বাধার দেওয়াল ডিঙাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে আজও!
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, ১৯৯৫ সালের ২৩ অগাস্ট দিবাগত রাত, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি বাসে করে দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় নামে ইয়াসমিন আক্তার নামে এক কিশোরী। তার বয়স আনুমানিক ১৬ বছর। ইয়াসমিন আক্তার ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁগামী একটি বাসে চড়েছিলেন তিনি।
দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় একটি পানের দোকানের সামনে সেই কিশোরী অপেক্ষা করছিলেন দিনাজপুরগামী বাসের জন্য। সে সময় টহলরত পুলিশের একটি ভ্যান সেখানে হাজির হয়। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি মেয়েটিকে পরামর্শ দেয় যে, পুলিশের গাড়িতে করে দিনাজপুর শহরে যেতে।
কিন্তু পুলিশের ভ্যানে করে সেই কিশোরী দিনাজপুর শহরে যেতে রাজী ছিলেন না। তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন যে, এত রাতে তার সেখানে একা থাকা নিরাপদ নয়। পুলিশের সেই ভ্যানে ছিলেন একজন এএসআই এবং দুই জন কনস্টেবল। শেষপর্যন্ত খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিশোরীটি পুলিশের ভ্যানে ওঠেন। এরপর দিন সকালে কিশোরীটির মৃতদেহ পাওয়া পাওয়া যায় গোবিন্দপুর নামক জায়গায়।
আজ ২৪ আগস্ট ‘জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ’ দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনেই কিশোরী ইয়াসমিনকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ধর্ষণের পর হত্যা করে। এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। প্রতিবাদের ঝড় উঠে সারাদেশে। সেই থেকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইয়াসমিন হত্যার ঘটনায় তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট ওই মামলার রায়ও হয়। আর ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির আট বছর পর ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওই রায় অনুসারে দোষীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২৬ বছর আগে, ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরে কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল! ইয়াসমিনেরা কি আজও মুক্তি পেয়েছে? এবং সমাজের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইয়াসমিনরা আরও পাশবিক অত্যাচারের শিকার! ঘরে-বাইরে নারীকে পণ্য হিসেবে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে একশ্রেণি।
কিন্তু আলোচিত সেই অপরাধ আর দৃষ্টান্তমূলক সেই শাস্তির পরও থেমে নেই নারীর প্রতি সহিংসতা। বরং ইদানীং তা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পতিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া ও সঠিক বিচার না হওয়ায় ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য মতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সময়ে মোট ৩ হাজার ৪৯৫ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৭২ জন কন্যা এবং ৩১৫ জন নারী। তার মধ্যে ১২১ জন কন্যাসহ ২২৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ২৩ জন কন্যাসহ ৩৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, সাত জন কন্যাসহ আটজন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ৯৪ জন কন্যাসহ ১৪০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৬৩ জন, এর মধ্যে ১২২ জন কন্যা। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১২৫ জন, এর মধ্যে ১০৪ জন কন্যা। তার মধ্যে উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ছয়জন কন্যাসহ সাতজন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন মোট ১ হাজার ৫২০ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে ৩৩০ জন নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২২৩ জন কন্যা এবং ১০৭ জন নারী। তার মধ্যে ২৮ জন কন্যাসহ ৬০ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১৬ জন কন্যাসহ ২৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণের কারণে একজন নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এ ছাড়া ৩৯ জন কন্যাসহ ৫৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৮২ জনের মধ্যে ৫৪ জন কন্যা। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৫৯ জন। এর মধ্যে ৫৫ জন কন্যা। তার মধ্যে উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আটজন কন্যাসহ ৯ জনের।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ তথ্যই বলে দেয়, বর্তমান সময়ে এসেও দেশে কন্যা-শিশু ও নারী নির্যাতন কত ভয়াবহ! আজও ঘরে-বাইরে নারীরা এতটাই নিপীড়নের শিকার যার সুরাহা আজও হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করলেও তা যথেষ্ট বাস্তবায়িত হতে দেখা যাচ্ছে না আজও! নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। সমাজে লৈঙ্গিক সমতা বিধান করতে পারলে ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হলে নারী নিপীড়ন কিঞ্চিৎ হলেও কমে আসবে। আজ ২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে নারীদের প্রতি সব ধরনের সহিংসতা-নির্যাতন প্রতিরোধের অঙ্গীকারই হোক আমাদের কাম্য। আর তাইতো আশায় বুক বাঁধি ইয়াসমিনরা মুক্তি পাক। মুক্তি ঘটুক মানবসত্তার এবং সেইসঙ্গে মানবচেতনারও উন্মেষ হোক।