Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোমোফোবিয়া!

বিশ শতকের প্রযুক্তির যুগে মানুষের হাতে হাতে মোবাইলফোন। বলা যায়, মানুষ এই ছোটো একটা বাক্সবন্দি। যেন মোবাইলফোন ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না। কোনো কারণে মোবাইলফোন হারিয়ে গেলে, বা নষ্ট হলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। ক্ষেত্রবিশেষে অস্থিরতা, মানসিক চাপ তৈরি হয়। কিন্তু অনেকের মধ্যেই মোবাইলফোন হারিয়ে গেলে, বা কাছাকাছি না থাকলে এক ধরনের মানসিক বিকার তৈরি হয়৷ এর একটা ভারী নাম আছে—নোমোফোবিয়া।


নোমোফোবিয়া (Nomophobia) যেটাকে ভাঙলে হয়, নো-মোবাইল ফোবিয়া। মানসিক এই সমস্যার কথা আমরা অনেকেই না জানলেও, আমাদের মধ্যেই অনেকেই এই রোগের শিকার। তবে, এটা যুক্তিযুক্ত যে ‘ফোবিয়া’ শব্দটি দিয়ে এই রোগের ভয়াবহতা প্রকাশ করলেও, উদ্বেগজনিত ব্যধি বলাটাই সংগত। যদিও নোমোফোবিয়া বর্তমানে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডারে নেই, তবে পঞ্চম সংস্করণ (ডিএসএম-৫)-এ এটি একটি ‘নির্দিষ্ট ভীতি’ হিসেবে প্রস্তাবিত হয়েছে। মনোবিজ্ঞানী Adriana Bianchi and James G. Philips তাঁদের জার্নাল Psychological Predictors of Problem Mobile Phone Use-এ বলছেন, কিছু মানসিক কারণ মোবাইলফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত। এই মানসিক কারণগুলোর মধ্যে ব্যক্তির আত্মসম্মানের অভাব (যখন আশ্বস্ত ব্যক্তিরা অনুপযুক্ত উপায়ে মোবাইলফোন ব্যবহার করে) এবং বহির্মুখী (এক্সট্রোভার্ট) ব্যক্তিত্ব (যখন স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক ব্যক্তিরা মোবাইলফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার করে) অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক ফোবিয়া বা সামাজিক উদ্বেগ ব্যধি, সামাজিক উদ্বেগ এবং প্যানিক ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যাগুলোও তাদের মধ্যে দেখা যায় এবং পূর্বের মানসিক ব্যধিগুলোর কারণে মনস্তাত্ত্বিক উপসর্গগুলোও হতে পারে।

২০০৮ সালের United kingdom-এর অন্যতম গবেষণা সংস্থা UGov-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রিটেনে প্রায় ৫৩% মোবাইলফোন ব্যবহারকারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যখন তারা ‘তাদের মোবাইল ফোন হারায়, ব্যাটারি বা ক্রেডিট ছাড়ায়, বা কোনও নেটওয়ার্ক কভারেজ থাকে না’। গবেষণায় ২ হাজার ১৬৩ জন লোকের নমুনা থেকে পাওয়া গেছে, প্রায় ৫৮% পুরুষ এবং ৪৭% নারী ভয়াবহভাবে ভুগছেন এবং অতিরিক্ত ৯% লোক মোবাইলফোন বাড়িতে রেখে আসার কারণে মানসিক চাপে পড়েন। জরিপের ৫৫% লোক উল্লেখ করেছেন যে, তারা মোবাইলফোন বাড়িতে রেখে আসার কারণে তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের যোগাযোগ রাখতে পারেন না। এই বিষয়টি তাদের মানসিক উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকায় মোট মোবাইলফোন ব্যবহারকারীর প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যক্তিই তাদের মধ্যে নোমোফোবিয়ার লক্ষণগুলো বিদ্যমান থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বাসায় মোবাইল ফোন রেখে আসা ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মানসিক অস্বস্তিতে ভুগে থাকেন। এমনকি ২৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষেত্রে চালকেরা দুর্ঘটনায় সময় মোবাইলফোন ব্যবহার করে থাকেন বলে পরিসংখ্যান দেখা গিয়েছে। ৬৯ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ঘুম থেকে উঠে কোনো কাজ করার আগে সবার প্রথমে মোবাইল ফোনে হাত দেন।

আপনি নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত যদি আপনি
১. রাতে প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর আপনার ফোন চেক করার জন্য জেগে ওঠেন।
২. দুপুরের খাবার বা রাতেও খাবার খাওয়ার সময়ও যদি আপনি ফোন চেক করেন।
৩. ফোনের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং পুনরায় চার্জ না দেওয়া পর্যন্ত শান্ত হতে পারেন না।
৪. ফোনে কোনো সিগনাল না থাকলে আপনার এমন অনুভূতি হয় যে আপনার জীবনটাই বুঝি বৃথা।
৫. আপনি যত ব্যস্তই থাকেন না কেন ফোনে কল আসলে আপনি তা রিসিভ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন।
৬. আপনি এমনকি ওয়াশরুমেও ফোন নিয়ে যান।
৭. এই লেখাটি পড়ার সময়ও আপনি অন্তত দুইবার আপনার ফোন চেক করেছেন
নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ সাধারণত নানান সামাজিক সমস্যাতেও ভোগেন। এটি উদ্বেগ তৈরি করে। ফোন থেকে দূরে থাকলে এই রোগে আক্রান্তরা উদ্বেগে ভোগেন। যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এর ফলে মনোযোগও নষ্ট হয়। যার ফলে কর্মস্থলে উৎপাদনশীলতাও কমে আসে। এছাড়া এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সময়ের অপচয় করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে মাল্টিটাস্কিং বা একই সময়ে একাধিক কাজ করা ক্ষতিকর। কারণ এভাবে তথ্য ধারণ ও প্রসেস করা যায় না। অনবরত ফোন চেক করলে সময়ের অপচয় হয় প্রচুর। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন আসক্তি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ফোন থেকে যে নীল আলো নিঃসরণ হয় তা মস্তিষ্কে এই সঙ্কেত দেয় যে এখন ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়। যা ঘুমের জন্য সহায়ক মেলাটোনিন হরমোনকে দমণ করে। নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত লোকেরা ত্বকের সমস্যায়ও আক্রান্ত হন। অনবরত ফোনের সংস্পর্শে থাকার ফলে ব্রন, অ্যালার্জি ও ডার্ক স্পট পড়তে পারে। এছাড়া পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় ফোন চেক করাটা নিষ্ঠুর আচরণ বলে গণ্য করা হয়। কর্মক্ষেত্রেও এই ধরনের কাজ করলে আপনাকে উদাসীন ভাবা হতে পারে।

চিকিৎসা :
নোমোফোবিয়া এখনো পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কোনো রোগ নয়। তাই এই রোগ নির্ণয়ের জন্য যেসব বিশেষ কোনো স্বীকৃত পদ্ধতি নেই। ২০১৫ সালে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী এই রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলেন। প্রায় তিন শ শিক্ষার্থীর ওপর সেই প্রশ্নমালা প্রয়োগ করে সেই শিক্ষার্থীর সফলও হয়েছিলেন। সাধারণত যেসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তারা যেকোনো ফোবিয়ার স্বাভাবিক লক্ষণগুলোর মাধ্যমেই রোগীর এই রোগ চিহ্নিত করে ফেলতে পারবেন। ওপরে যেসব লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, সেসব হঠাৎ দেখা দিলেই একজন মানুষ নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত, এমনটা বলা যাবে না। তবে যদি লক্ষণগুলো ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা বিদ্যমান থাকে, সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হওয়াই ভালো।

অনন্যা/ ডিডি

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ