সুদের টাকার জন্য নারীনির্যাতন: কঠোর শাস্তি হোক
নারী নির্যাতন আমাদের সমাজে খুবই নগণ্য ঘটনাগুলোর একটি। অর্থাৎ এ সমাজে নারী যেন নির্যাতনেরই সামগ্রী। সব আক্রোশ গিয়ে পড়ে নারীর ওপর। পরিবারে-ঘরের বাইরে সর্বত্র নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়েই যুগ যুগ ধরে মানুষ তার আক্রোশ, হিংসা-বিদ্বেষ মেটায়। রামপত্নী সীতাকে হরণের মাধ্যমে রাবণ তার আক্রোশ পূর্ণ করতে চেয়েছিল৷ পরবর্তীকালে রাবণের কারণে স্বামী রাম কর্তৃক সীতাই অপরিতাজ্য হয়েছে।
সমাজে পুরুষ তার জায়গাকে সচল রাখতেও নারীকেই বিসর্জন দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে এসব কাহিনি চলেই আসছে। এরপর যদি মহাভারতের যুগে প্রবেশ করি সেখানেও দেখা যাবে নারীই ভোগ্যপণ্য। দ্রৌপদীর প্রতি দুর্যোধন, দুঃশাসনের আক্রোশ। সেই আক্রোশ এসেছে কিন্তু পাণ্ডু পুত্রদের কারণেই। পাশা খেলায় দ্রৌপদীকেও নিলামে তোলা হচ্ছে। একসময় সবকিছু হারালে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টার মতো পাশবিক নির্যাতন করে কৌরবরা। এসব নতুন নয়। নারী নির্যাতন এ সমাজে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। প্রকৃতার্থে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে ভোগ্যপণ্য করে তোলার মানসিকতায় এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সৃষ্টি করে। কালের অববাহিকায় নারী আজও নির্যাতনের শিকার। কখনও পরিবার-পরিজন দ্বারা আবারও কখনও বাইরে। এমনকি পরিবারের সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র- দ্বেষের শিকারও নারী হন। যতদিন মানবিক বোধ মানুষের মধ্যে না জন্মাবে ততদিন নারীর প্রতি এ ধরনের আচরণ রোখা সম্ভব নয়৷
সম্প্রতি সুদের টাকার জন্য নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এবং এরফলে তার স্বামী আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ঘটনাটি এরকম, পাররাণীরপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেকের স্ত্রী রিমা বেগম তার স্বামীকে না জানিয়ে পার্শ্ববর্তী চকবেড়া গ্রামের গোলজার রহমানের কাছ থেকে চার মাস আগে ৩৬ হাজার টাকা সুদের উপর ধার নেন। গোলজার জামানত হিসেবে রিমা বেগমের কাছ থেকে দেড় ভরি গহনা এবং দুটি অলিখিত চেকের পাতা বুঝে নেন। সেই ৩৬ হাজার টাকা এখন সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার টাকা।
সুদের ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য গোলজার রিমাকে চাপ দিতে থাকেন এবং তার স্বামী আব্দুল মালেককেও বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে গোলজার গত বৃহস্পতিবার রাতে রিমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত বাঁশঝাড়ে আটকে রাখেন। পরদিন শুক্রবার রিমা বেগমের বাবা উনচুরখী গ্রামের আব্দুর রহিম প্রামানিক গরু বিক্রি করে ৭৫ হাজার পরিশোধ করেন। রিমার গচ্ছিত গহনা ও চেকের পাতা ফেরত দেওয়ার জন্য তার স্বামী আব্দুল মালেকের কাছ থেকে আরো টাকা দাবি করে হুমকি দেন গোলজার। পরে অপমান সহ্য করতে না পেরে আব্দুল মালেক শনিবার দিবাগত রাতে তার ঘরের তীরের সঙ্গে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। এবং পরবর্তীকালে রিমা বেগম বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ গোলজারকে গ্রেপ্তার করে।
সুদের টাকার জন্য নারী নির্যাতন এবং পরবর্তীকালে ভুক্তভোগী নারীর স্বামীর আত্মহত্যা। সবটাই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তবে নারীর ওপর নির্যাতন এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনা না ঘটিয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারতো উভয় দল। সুদের টাকা নেওয়া এটা ধর্মীয়ভাবে যেমন হরাম বা অন্যায় তেমনই এর কারণে নারীর ওপর নির্যাতন চূড়ান্ত অন্যায়। আর পরবর্তীকালে আত্মহত্যাও এক অপরিণত সিদ্ধান্ত। ঘটনাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত।
নারীর ওপর নির্যাতনের এমন ঘটনা সত্যি আমাদের সমাজে নতুন নয়। তবে এসব অনৈতিক ও অমানবিক কর্মযজ্ঞ বন্ধে মানুষের বিবেক-মনুষ্যত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নিজের পাওনা টাকা-পয়সা বা জায়গা-জমির চেয়ে জীবন অবশ্যই বড়। তাছাড়া এর জন্য দেশের আইন-কানুন আছে। অযথা অন্যায় পথে পা বাড়িয়ে নিজের এবং পরিবারের বিপদ বাড়ানো বোকামি। মোদ্দা কথা হলো, এমন ঘটনা বা অন্যান্য যেকোনো পরিস্থিতিতেই নারীকে শিকারে পরিণত করা এ সমাজের এক ধরনের ব্যাধি। এসব ব্যাধি তখনই কাটতে পারে যখন নারীর ওপর প্রকৃত সম্মান সৃষ্টি হবে। এজন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। যাতে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়।