অনুপ্রেরণার অন্যনাম টিনা টার্নার
জীবন চলার পথে বাধা তো আসবেই তাই বলে কি থমকে যেতে হবে! নাকি জীবন থেকে পলায়ন করতে হবে? এ সম্পর্কে জ্ঞানী ও বিজ্ঞ মানুষদের কথা তা অবশ্যই নয়।
কারণ মানুষ মাত্রই জানেন যে, জীবন একটি সংগ্রামের নাম। বেঁচে থাকতে হলে, নিজের অবস্থান উন্নত করতে হলে সর্বদা মানুষকে সচল থাকতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে ভাগ্যের বদল ঘটাতে৷ যিনি তা পারবেন না, তার জন্য অবশ্যই রয়েছে দুঃসহ বেদনা। আর যে ব্যক্তি সাধনা করবেন তিনি একদিন না একদিন নিশ্চিতভাবেই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাবেন। এগুলো আমরা শুনে আসছি পৃথিবী সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই। শুধু যে শুনেই ক্ষান্ত, তা নয় বরং কেউ কেউ তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেন এই অমোঘ বাণীগুলো। তেমনই একজন টিনা টার্নার।
তিনি ১৯৩৯ সালের ২৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির নাটবুশে জন্ম। বাবা–মা নাম রেখেছিলেন আনা মাই বুলক। বাবা কাজ করতেন স্থানীয় এক ফার্মে। তাঁর পুরো জীবনটায় দুঃখের। বাবা- মা’র বিচ্ছেদ এবং তাদের দুটি পথ দুদিকে গেলেও ছোট্ট আনার জন্য ছিলেন কেবল দাদি। তাঁর কাছেই অতি কষ্টে বড় হয়েছেন।
আনার বয়স যখন ১৬, মিজৌরিতে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। এখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় গিটারিস্ট ইক টার্নারের সঙ্গে। আট বছরের বড় ইক তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। আনাই ইককে রাজি করান তাঁর সঙ্গে গাইতে। ১৯৬০ সালে হিট গান ‘আ ফুল ইন লাভ’ দিয়ে আনাকে শ্রোতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ইক। ইকই আনার নাম দেন টিনা টার্নার। দুজন মিলে ‘ইক অ্যান্ড টিনা টার্নার’ নামে পারফর্ম করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে দুজন বিয়েও সেরে ফেলেন। ষাটের দশকের শুরু থেকে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুজন একরকম ‘শাসন’ করেন বিশ্বসংগীতের দুনিয়া।
পরবর্তী গল্পের কিয়দংশ ইক জড়িত থাকলেও পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। টিনা ছিলেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। যখন যেখানে হাজির হতেন, সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিতেন। মঞ্চে তাঁর পারফর্ম ছিল আকর্ষণীয়, গান আর নাচে জাদুবন্দী করে রাখতেন দর্শককে।
তবে স্বামী ইকের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে, যার প্রভাব পড়ে গানেও। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে ইক কোকেনের নেশায় ডুবে যান। স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন টিনা। পরে ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে একটি ট্যুরে মাঝপথে পকেটে মোটে ৩৬ সেন্ট সম্বল করে স্বামীকে ছেড়ে চলে আসেন টিনা। বেছে নেন স্বাধীন জীবন। ২৭ জুলাই করেন বিচ্ছেদের আবেদন। তাঁদের বিচ্ছেদ হওয়ার পরও ইক ও টিনার দুটি অ্যালবাম মুক্তি পায়। কিন্তু ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে টিনার আপন ভুবন।
কথা হলো টিনার শৈশব, কৈশোর এমনকি সাংসারিক জীবন কোনটাই সুখের ছিল না। প্রতিটি পদেই তাঁকে দুঃখ এবং দুঃসহ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। বাবা-মায়ের ছেড়ে চলে যাওয়া, দাদির কাছে মানুষ হওয়া, প্রেম- দাম্পত্য সংকট সবই এক জীবনে ভোগ করেছেন। শেষমেশ স্বামীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে বিচ্ছেদ। টিনার জার্নিটা যত সহজে উচ্চারিত হচ্ছে ঠিক ততটা সহজ নয়। জীবনের কষ্টগুলোকে একাই পার করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি তাঁর সুরেলা কন্ঠে দর্শকের মন কেড়ে নিলেও জীবনের দুঃখ-গ্লানি তাঁকে পিছু ছাড়েনি। তবু তিনি টিনা টার্নার দুঃস্বপ্নের শৈশব পেরিয়ে রক অ্যান্ড রোলের রানি হয়ে ওঠেন। তাঁর এই পদযাত্রা প্রত্যেক নারীর জীবনে অনুপ্রেরণা। জীবন চলার পথে যদি টিনা টার্নারের মতো মনোবলসম্পন্ন নারীরা উদাহরণ হয়ে থাকেন তবে কেনো আর এত গ্লানি! কেনো এত হতাশা এবং বিষণ্নতায় ছেঁয়ে যাওয়া। টিনা টার্নার হোক প্রত্যেক নারীর জন্য প্রেরণা।
জীবন যেমন দুঃখময় ঠিক তেমনই দীর্ঘ সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। শেষমেশ ভবলীলাসাঙ্গ করে চলে যাওয়া। এ পৃথিবীর নিয়মই এটা। কেউ তার উর্ধ্বে নয়। কারণ প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।
এই মহীয়সী, সুরের যাদুকর, জীবন পথে হার না পথিক গত ২৪ মে মৃত্যুবরণ করেছেন। গত শতকের অন্যতম জনপ্রিয় গায়িকা টিনা টার্নারের প্রায়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু কারো কারো দৈহিক প্রস্থান ঘটলেও থেকে যান তাঁর কর্মের মাঝে। টিনা টার্নারও থাকবেন ভক্তকুলের প্রেরণা হয়ে।