Skip to content

৬ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তি রাণীদের মুক্তি কোথায়!

আজকাল কিছু কিছু ঘটনা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়! গা শিউরে ওঠে! ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে শঙ্কাবোধ হয়! এই সমাজই কি আমরা চেয়েছি? আমাদের সন্তানেরা যেখানে নিরাপদ নয় তেমন পৃথিবীর কী দরকার! সমাজে নারীর প্রতি অত্যাচার- নিপীড়ন নতুন নয়। তবু এ কোন বিভৎস সমাজে আমরা অবস্থান করছি! যেখানে একটি নাবালক মেয়েকে এভাবে জীবন হারাতে হয়! শুধু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এতটা আক্রোশ উগ্রে দিতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। বিবেকহীন মানুষের আক্রোশের শিকার হতে হয় মুক্তি রাণীদের! কী দোষ মুক্তি রাণীদের? মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াই কি পাপ! নাকি আমাদের এই কদর্য সমাজে মেয়েদের জীবনধারণ করা পাপ! অকালে একটি ফুলের মতো জীবন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো এর দায় কার! কিভাবে এই শোক ভুলবেন পরিবার- পরিজন। আর কত মুক্তি রাণী প্রাণ হারালে আমাদের টনক নড়বে!

নেত্রকোনার বারহাট্টায় দশম শ্রেণির স্কুলছাত্রী মুক্তি রানী বর্মণকে (১৬) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মুক্তি রাণী বর্মন বারহাট্টা উপজেলার বাউসী ইউনিয়নের প্রেমনগর ছালিপুরা গ্রামের নিখিল বর্মনের মেয়ে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্কুলে যাওয়া আসার পথে মুক্তি রানীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে উত্যক্ত করত কাওসার। একই গ্রামের বাসিন্দা কাওসার। প্রেমে সাড়া না দেওয়ায় মুক্তির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে সোমবার ( ২ মে) দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দা দিয়ে কুপিয়ে মুক্তি রানীকে গুরুতর জখম করে কাওসার। পরে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি লক্ষ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বিকেল ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়। মুক্তির মৃত্যুর পর তারা বাবা থানায় মামলা করেন।

পরবর্তীকালে বুধবার (৩ মে) বেলা পৌনে ৩টার দিকে উপজেলার প্রেমনগর ছালিপুরা গ্রামের ধানক্ষেত থেকে কাওসার মিয়াকে আটক করে জেলা গোয়েন্দ পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পর কাওসার ওই ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিল। মুক্তি যেন অন্য কারো না হতে পারে সেজন্য দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আটক কাওসার। এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিবেকসম্পন্ন মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। সবার মনে একই প্রশ্ন, আমাদের সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়!

নেত্রকোণা জেলায় মুক্তি রানীর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সরব হয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। উদ্বেগ- ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে জনমনে। কিন্তু একটু দৃষ্টি ফেরালেই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, এই ঘটনা খুবই সাধারণ! আমাদের সমাজে মেয়ে- নারীরা বিভিন্নভাবে হেনস্তা হন। সমাজের কোনোই বিকার নেই এ নিয়ে। সবাই এক অদ্ভুত রেসে যুক্ত হয়েছে। মানবিকতাবোধের বিকাশ, মানবতার চর্চা আমাদের সমাজে নেই। মুক্তি রানীরা কেন হত্যার শিকার হচ্ছে? কেন গুম – খুন ধর্ষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে নারী। সমস্যার সমাধানে মূলে আঘাত না করলে কোনোদিন এ সমাজ কলঙ্ক মুক্ত হবে না! তবু শুধু যখন ঘটনাগুলো ঘটে তখনই আমাদের মস্তিষ্ক নাড়া দেয় এবং পরবর্তীকালে আমরা শান্ত জলের মতো যে যার কাজে মনোযোগী হয়ে উঠি!

মুক্তি রানী নাবালক এবং বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করছে মাত্র। তার জীবনটা এভাবে নিমেষেই শেষ হয়ে গেলো! অপরাধীর শাস্তি প্রশ্নবিদ্ধ। যদি শাস্তি হয়ও তবু এই বাবা- মা তথা পরিজনদের ক্ষত কি কোনদিন শুকাবে? বাবা- মায়ের আদরের ধন এভাবে হিংস্রতায় শেষ হয়ে গেলো তাদের চোখের জলে বুক ভাসানো ছাড়া আর কোনোই গতি কি আছে!

প্রতিনয়তই স্কুল- কলেজগামী এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গামী, বয়োবৃদ্ধ সবশ্রেণিপেশার মেয়ে- নারীরাই ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, ধর্ষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে। কোথাও এবং কোনো সম্পর্কেই মেয়েরা নিরাপদ নয়। মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো নারীই নিরাপদ নয়। তাহলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে? নারীরা কোথায় যাবে!

একা সরকারের পক্ষে কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে যতদিন ভোগ্যপণ্য মনে করা হবে ততদিন মুক্তি রানীদের মুক্তি নেই! এ সমাজ যতদিন নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে না শিখবে ততদিন শুধু খনিকের ক্ষোভ- উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া গত্যন্তর নেই। সমস্যা গোঁড়ায়৷ জলটা সেখানে ঢালতে হবে। কেনো কাওসারদের জন্ম হচ্ছে? আর কেনো মুক্তি রানীরা অকালে ঝরে পড়ছে! স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে এ ধরনের আক্রোশ, মানসিকতা নেই এমনটা নয়। নারীকে দেখলেই অধিকাংশ পুরুষের লালসা জেগে ওঠে। যার চরম বলি ছোট্ট মুক্তি!

অহরহ ঘটে যাওয়া এই কদর্য বিভৎসতা আর দেখতে চাই না। মুক্তি রানীরা মুক্তি পাক। তারা রাস্তা-ঘাট – পথে – প্রান্তরে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠুক- গড়ে উঠুক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়ে আর কত সিঁটিয়ে থাকবে মুক্তিরা!

মুক্তিদের মুক্তি ঘটাতে এ সমাজের মর্মমূলে আঘাত হানতে হবে। বিবেক, মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। জাগ্রত করতে হবে। যেই সমাজ থেকে মানবতার শিক্ষা উঠে যায় সেখানে মুক্তি রানীদের মুক্তি নেই। কারণ পরিবার- সমাজ কাওসারদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। যতদিন কাওসারেরা তাদের চোখের বিষে নারীকে ছিঁড়ে খাবে ততদিন এই শকুনদের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। আইনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তবে শুধু আইন করে, আইনের বাস্তবায়ন করেই এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে একশ্রেণিকে নিবৃত্ত করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন মানবিক বোধের। তাই সমাজে মনুষ্যত্ব- বিবেকের চর্চা করতে হবে ।

মুক্তি রাণীরা আর কেউ নয় আমাদের মা- বোন- মেয়ে এই ধারণায় গড়তে হবে সমাজ। আর যতদিন এই বোধে উন্নীত হওয়া যাবে না ততদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই কদর্য হিংস্রতা কমবে না। মেয়েদের পথচলাকে বারবার কণ্টকিত করবে কাওসার নাম্নী পিশাচেরা। একটাই চাওয়া, নারীর জন্য সমাজ হোক ভরসাস্থল, নির্ভীক পথের সহযাত্রী। যাতে মুক্তি রানীদের আর অকালে চলে যেতে

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ