মহান মে দিবস: দূর হোক সব বৈষম্য
আজ ১ লা মে। মহান মে দিবস। এই দিনটি আজ আর কারও অজানা নয়। শ্রমের মূল্য নির্ধারণের জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছিল। আমরা মহান মে দিবসের যে চেতনা নিয়ে কথা বলি, সে চেতনা ঠিক কতটা আমাদের নিজস্ব? এই প্রশ্ন তুললেও এমনটি বলা যাবে না—মহান মে দিবসের চেতনা ধারণ করা যাবে না। বরং একটি প্রশ্ন সামনে আনতেই হবে, মহান মে দিবসের চেতনাকে আমরা কতটা আত্মস্থ করেছি?
ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের বঞ্চনা-শোষণের ইতিহাস রচিত হয়েছে। বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় অনেক সময় শোষিত-বঞ্চিতরা সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছে। এসব শোষিত-বঞ্চিত মানুষ কখনো অধিকার আদায়ে সফল হয়েছে, কখনো ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে হারিয়ে গেছে। কারণ পুঁজিবাদী-শোষক গোষ্ঠী শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা কোনোকালেই বুঝিয়ে দিতে চায়নি। তাই শ্রমকে পুঁজি করে বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে শ্রেণী-বিভেদ। এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর ওপর চেপে বসে করেছে শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন।
শিল্পের বিকাশের জন্য চাই শিল্প। শ্রমিক সমস্ত দিন কঠোর পরিশ্রম করে শিল্প সৃষ্টি করে, কিন্তু বিনিময়ে তার ভাগ্যে জোটে সামান্য মাত্র মজুরি। সেই মজুরিতে পেট ভরানোর মতো রুটিটুকু জোটানো সম্ভব হয় না। অথচ তারই তৈরি শিল্পের মুনাফা ভোগ করে পুঁজিপতিরা হয় সুবিশাল অট্টালিকার অধিকারী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের কথা। ৮-১২ ঘণ্টা খেটে পায় মাত্র ৮-১২ হাজার টাকার মতো, যা দিয়ে শহুরে জীবনে টিকে থাকা অকল্পনীয়। এই মজুরিতে চলে না সংসার। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী দুজন একসঙ্গে কাজ করেন সংসারের হিসাব মেলাতে।
আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তির বড় একটি অংশ এখনো গার্মেন্টস শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। শুধু তৈরি পোশাকই নয়, শ্রমিক অবদান রেখে চলেছে দেশের প্রতিটি খাতে। দেশের প্রধান ও বড় শিল্পখাতের দিকে যদি চোখ ফেরানো যায় তাহলে আমরা বরাবরই দেখবো শ্রমিকের মজুরি কম। চা শ্রমিকের আন্দোলনের ঘটনা এখনো পূরণ হয়নি। এছাড়া, বড় অনেক শিল্পেই শ্রমিকের চাকরিচ্যুতির ঘটনা, তাদের নিরাপত্তার অভাব এমনকি যেকোনো সময় বিনা কারণে অত্যাচারের ঘটনা কি ভুলে যাওয়া যায়? প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে এমন খবর আমরা পাই। প্রতিনিয়ত দেখছি। কিন্তু সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়ে আমরা পিছিয়েই আছি।
মহান মে দিবসে আমরা যে তথাকথিত শ্রমিকের কথা বলি, তার ধারণা অনেক সংকীর্ণই। অথচ শিকাগোর হে মার্কেটে যখন মে দিবসের ইতিহাস রচিত হচ্ছিল, তখন ভারতে অমন শ্রমিক শ্রেণী গড়ে ওঠেনি। গড়ার সম্ভাবনাও ছিল না। কিন্তু শ্রমিক তো সবখানেই ছিল। তাকে তো আর নাকচ করা সম্ভব না। কিন্তু শ্রমিক শব্দটির পরিসর অনেক বড়। এখনো আমাদের দেশে অনেক জায়গায় শ্রমিকের শ্রমের মূল্যায়ন করা হয়নি। এখনো হয় না। নারীর শ্রমের মূল্যায়ন নেই। অথচ অর্থনীতির ভারকেন্দ্রে এখনো নারী অবস্থান করছে। বিষয়টি শুধু নারীতেই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ নারী-পুরুষ বিভাজন বাদেই মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা আসেনি। এই মানুষগুলোকে উদ্বৃত্ত করে মে দিবসে শিক্ষিত-সজ্জনদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
মে দিবসে শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তিদের একটি দায়িত্ব থাকে। এই দায়িত্বের মাধ্যমে যারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সেই গোষ্ঠীকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করতে হয়। শুধু মে দিবসের চেতনাকে শ্রদ্ধা জানালেই হবে না—এজন্যই মে দিবসের সেই প্রতীকী গাছের কথা বলতে হয়। গাছটিকে ছুঁতে গেলে কাটার ঘা খেতেই হয়। আবার ফুল ফুটলে সুন্দরও লাগে। তাই মে দিবসকে জাতীয় জীবনে প্রয়োগ ব্যতীত উপায় নেই। মে দিবস ঠিক ওই কাঁটার মতোই প্রাসঙ্গিক। আবার মে দিবসের চেতনা অতটাই সুন্দর। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও শ্রমের অবকাঠামো বিবেচনায় শ্রমিক যেন তার নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে সে প্রচেষ্টাই হোক মে দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য। নতুবা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এই দিনের প্রভাব আগামী বিশ্ব দেখবে কী করে? দেখার সম্ভাবনাও থাকবে না।
পুঁজির মালিক কেবলই পুঁজি খাটিয়ে ধনী থেকে ধনীতর হচ্ছে। আর শ্রমিক রাতদিন খেটে খেটে প্রথমে স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে, পরে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সামান্য উপার্জনটুকু হাসপাতালে দিয়ে আসছে। আর অধিকার আদায়ের জন্য বারবার আন্দোলনে নেমে ঝরাতে হচ্ছে রক্ত। ফলে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি তথৈবচ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—শ্রমিককে এই রক্ত কি ঝরাতে হবে আরও বহুবার?
অনন্যা/এআই