Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীশিক্ষা: রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ-পরিবারকেও সচেতন হতে হবে

কথায় বলে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। একটি দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত বেশ বৈষম্য থাকে। শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা আলাদা দেখা যায়, লিঙ্গভেদে। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেই যদি ধরি, পরিবার বা অভিভাবকরা ছেলেসন্তানের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিধা পোষণ না করলেও মেয়েসন্তানের বেলায় দশবার ভাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শুরুর দিকে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই স্কুলে ভর্তি করা হলেও ধীরে-ধীরে ঝরে যায় মেয়েরা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক প্রতিটি পর্যায়ে একটি বিশাল অঙ্কের নারী শিক্ষার্থী ঝরে যেতে থাকে। তার ওপর মাঝে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনা।

টানা দু’বছর করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাতে বড় কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ঝরে পড়ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা। কভিড-১৯ সংক্রমণকালে ও পরবর্তী সময়ে শিখন ঘাটতি মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে বাল্যবিয়ের শিকার ও শ্রমঘন কাজে জড়িয়ে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে ছিল না সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম। ফলে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র মিলেছে। এতে দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সাড়ে ৯ লাখ শিশু আর বিদ্যালয়েই আসছে না। তাদের প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, যার অর্ধেকই আবার কন্যাশিশু। করোনাকালে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় অভিভাবকরা অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের শ্রমঘন কাজে সংযুক্ত করেছেন। আর কন্যাশিশুদের বড় একটা অংশেরই বাল্যবিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)এর করা জরিপের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান মাউশি বলছে, কেবল ২০২১ সালে মাধ্যমিকের ৪৭ হাজার ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। তাদের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে ২০২১ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় পৌনে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে শিশুশ্রমে যুক্ত ৭৮ হাজার। দেশের ২০ হাজার ২৯৪ বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১ হাজার ৬৭৯টির তথ্য পেয়েছে মাউশি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম সবচেয়ে বেশি রাজশাহী অঞ্চলে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২২’-এর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় ২ হাজার ৩০১ জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি মাসে ২৮৮ জন কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে এবং একই সময়ে ৫৮৯টি প্রতিরোধ করা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে দেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে। সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছে তারা।

করোনার পরে বাল্যবিয়ে, পারিবারিক ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীশিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রগতি যেন আরও মুখ থুবড়ে পড়ছে । সরকার উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বইপ্রদানসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীশিক্ষায় জোর দিতে চাইলেও সমাজ যেন, কোনোভাবেই মানতে নারাজ। আর্থিক সংকটের মধ্যে ছেলেশিশুর শিক্ষাকার্জক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও কন্যাশিশুর বেলায় তা একদমই দেখা যায় না। বরংচ এমন পরিস্থিতিতে কন্যাকে বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হওয়ার চেষ্টা থাকে পরিবারগুলোর।

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনো প্রগতিশীল নারীদের পথ আটকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, মেয়েদের পড়ালেখা করে কী হবে? তাদের মতে মেয়েদের জন্ম হয়েছে সংসার সামলানোর জন্য, বাইরের পৃথিবীতে একা চলার অধিকার নারীর নেই। গত কয়েক দশকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, তার খুব কম অংশই সমাজের চোখে পরেছে। তারা নারী-শিক্ষার বিপরীতে কোনো যুক্তি খুঁজে বের করতে মরিয়া। দেশের উন্নয়ন কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে নারীকে সমানভাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে।

পুরুষের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীশিক্ষার এমন বেহাল দশা নারী-শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তবে এই দায় শুধু রাষ্ট্রের নয়, এ দায় নিতে হবে সমাজ ও পরিবারকেও। শুধু রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপে নারীশিক্ষার খুব বেশি উন্নতি দৃশ্যমান হবে না, যদি সমাজ ও পরিবার একযোগে সচেতন না হয়।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ