Skip to content

১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর আত্মহত্যার প্রথম দায় পরিবারের

এই কথা বারংবার বলা হয়, এ সমাজ নারীকে যোগ্য মূল্যায়ন করতে জানে না। নারীকে একটা গণ্ডিতে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে। কিন্তু একটিবারও নারীরা কিভাবে এবং কেমন করে টিকে থাকে, সে সম্পর্কে ভাবার অবকাশও থাকে না। তবে সমাজ যতটা না নারীর জীবনকে হেয় করছে, তার চেয়ে বেশি একজন নারীকে আত্মহত্যা, গুম, খুনের পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।

মেয়ে সন্তান হলেই তাকে বোঝা ভাবার মানসিকতা এখনো এই সমাজকে গ্রাস করে রেখেছে। মেয়ে হয়ে জন্মালেই পরিবার তাকে গলগ্রহ ভাবার ফলে বর্তমান সময়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে! কিন্তু বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে এর দায় তারা শুধু স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকছে। কপাল বা ভাগ্যের দোষ দিয়ে নিশ্চুপ থাকছে। কিন্তু এসব ঘটনার পেছনের কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, এর প্রধান ও একমাত্র দায় পরিবারের। অধিকাংশ নারীর ভয়াবহ জীবনের পেছনে তার পরিবারের দোষ সর্বাধিক। কারণ এসব ঘটনার সূত্রপাত ঘটে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই।

আজকের সমাজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যন্ত্র সভ্যতার উন্নয়নে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যস্ত। তবে এই তাল মিলিয়ে চলতে চাইলেও আজও আমাদের পরিবার, সমাজের ভেতরকার কদর্যতার এতটুকুও পরিবর্তন ঘটেনি। কন্যা সন্তানকে কোনো রকমে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই যেন পরিবারগুলোর শান্তি! এরপর কন্যা সন্তানের যা-ই হয়ে যাক না কেন, তাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তাদের ধারণা ও বিশ্বাস, যেহেতু কন্যা সন্তান জন্মেই গেছে, সেহেতু তাকে যেভাবেই হোক আধপেটা খাইয়ে হলেও বড় অর্থাৎ বিয়ের উপযুক্ত করে তুলতে হবে। তাহলেই পরিবারের ল্যাঠা গেলো চুকে! তাই এটা বলা অত্যুক্তি হয় না যে, এই পরিবারই নারীর হন্তারক। এই পরিবারই কন্যা সন্তানকে অবজ্ঞা, অবহেলা, অযত্নে, অবমূল্যায়ের সঙ্গে পাড়ি দেওয়াতে শেখায় জীবনকে। এই পরিবারই নারীকে শেখায় একবার বাপের বাড়ির গণ্ডি পেরুলে মরে লাশ না হওয়া পর্যন্ত আর পিতৃগৃহে ফেরত আসা যাবে না।

সদ্য ঘটে যাওয়া তিন জন নারীর মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে উপরিউক্ত আলোচনা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা পরিষ্কার হবে আশা করি।

প্রথম ঘটনা
গণমাধ্যমে বরাতে জানা যায়, পুরান ঢাকার লালবাগ থানার শহীদনগর এলাকার ভাড়া বাসা থেকে শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় লতিফা হেলেন (৩০) নামের এক নারীর অচেতন দেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের সদস্যরা জানান, লতিফা আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে তার বাসাভাড়া বকেয়া। এ নিয়ে বাড়িওয়ালা প্রতি মাসে অপমান করেন। কটু কথা শুনতে হয়। লতিফার ছোট ভাই বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আমার বোন সন্তানকে নিয়ে লালবাগ এলাকায় আলাদা বাসায় ভাড়া থাকতেন। তিন মাসের ভাড়া জমে যাওয়ায় তিনি বাড়িওয়ালার চাপে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। বিষয়টি সমাধানে সন্ধ্যায় তার ছেলের সঙ্গে অনেক কথা-কাটাকাটি হয়। পরে ছেলেকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে অভিমানে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখেন। অনেক ডাকাডাকি করেও তার কোনো সাড়া না পেয়ে আমরা ঘরের দরজা ভেঙে দেখি তিনি ঝুলছেন। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত ঘোষণা করেন।

লতিফা হেলেন বয়স মাত্র ৩০। একটি ছেলে সন্তান বয়স ১৬। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা নেই। ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। এর সবটাই পরিবারের সদস্যরা জানেন। একইসঙ্গে স্বীকারও করছেন নির্বিকার চিত্তে। তাহলে আমাদের পরিবারে নারীর অবস্থান কোথায়? নারীকে এই পরিস্থিতে কিভাবে টিকে থাকতে হবে সেই শিক্ষা কেন পরিবার দেয় না? একজন নারী এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করলেই কেন তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে? বিষয়টি যদি এমন না হয়ে ভিন্ন রকম হতো, তবে হয়তো এই নারীর এমন পরিণতি হতো না। যদি নারীটি স্বাবলম্বী হতেন, নিজের বাসা ভাড়ার টাকা নিজে জোগাড় করতে পারতেন, সন্তানকে নিজের মতো করে মানুষ করে তুলতে পারতেন; সর্বোপরি সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর যদি পরিবারের সদস্যরা পাশে দাঁড়তেন, সাহস জোগাতেন, স্বাবলম্বী করে তুলতে সহয়তা করতেন, পৈতৃক সম্পত্তির যতটুকু ভাগ-বণ্টন করে দিয়ে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই দিতেন, তাহলে কি সত্যি লতিফা হেলেনকে অকালে ঝরে যেতে হতো? না কি অনেক সমস্যায় মূলেই বিনাশ হতো।

তবে সব ঘটনার আগেও কিছু ঘটনা থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কিন্তু আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে, সন্ধ্যের দীপ জ্বালানোর পূর্বে সলতে পাকানো।’ ঠিক তাই এই নারীরা যদি স্বাবলম্বী হতেন, বাল্যবিবাহের শিকার না হতেন, পড়াশোনা করে ভালো-মন্দের বিভেদ বুঝতে পারতেন, জীবনকে সঠিক ও পরিপূর্ণ চিনতে পারতেন, তবে হয়তো অন্য কথা বলতে সক্ষম হতেন। জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রকৃত ক্ষমতা তৈরি হতো। জীবনবোধ তৈরি হতো।

দ্বিতীয় ঘটনা
রাজধানীর ডেমরায় পারিবারিক কলহের জেরে মুনিয়া আক্তার (২২) নামের এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় স্বামী দীন মোহাম্মদকে আটক করা হয়েছে। মুনিয়ার বাবা নাসির বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার মেয়ের সঙ্গে দীন মোহাম্মদের বিয়ে হয়। তাদের সংসারে ১১ মাসের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।’ বাবার বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট, তার মেয়ের সংসারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। তবে অপরিণত বয়সেই তাকে হারিয়ে যেতে হলো?

তৃতীয় ঘটনা
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে বিয়ের ১০ মাসের মাথায় শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) মানসুরা আক্তার (১৯) নামে এক গৃহবধূ স্বামীর বাড়িতে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই নিহত গৃহবধূর স্বামী বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।

তিন জন নারীরই প্রাণ গেলো আত্মহত্যার মাধ্যমেই। এই আত্মহত্যাগুলোকে যতই অনাকাঙ্ক্ষিত বলা হোক না কেন, পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করলে হয়তো তিন জনের কাউকেই অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হতো না। এর পুরো দায় তাদের পরিবারের। দাম্পত্য কলহ তো একদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হয় না। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-গঞ্জনা-অবহেলা-নিপীড়নই নারীকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়।

লতিফা হেলেন, মুনিয়া আক্তার ও মানসুরা আক্তার কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছেন? পরিবারের সদস্যদের কি কিছুই করার ছিল না! না কি কন্যা সন্তানের বিয়ে হলে পিতৃগৃহ তাকে আজন্মের মতো ত্যাগ করে! যদি পরিবার থেকে নারীরা এমন নিগৃহীত হয়, তবে তাদের স্বাবলম্বী করে, পড়াশোনা শিখিয়ে, জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিয়ে পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত করা হয় না কেন?

আমাদের পরিবার, সমাজের চিন্তাধারা পাল্টালে তবেই লতিফা, মুনিয়া, মানসুরাদের মুক্তি ঘটবে। না হলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কিছুতেই রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। নারীর আবরণে অবরুদ্ধ না করে, অপসংস্কৃতির চর্চা না করে নারীকে পরিপূর্ণ শিক্ষা, স্বাবলম্বিতা, ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই এই অমাবস্যার ঘরে জোছনার আলো আসতে শুরু করবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ