নারীদের যেসব অধিকার কেড়ে নিলো তালেবান
গতবছর যখন তালেবান ক্ষমতায় আসে, তখন আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল আফগান নারীদের নিয়ে। তালেবানদের শাসনামলে আফগান নারীদের পরিণাম কী হতে পারে, তা মোটামুটি আঁচ করতে পারছিল বিশ্ববাসী। গতবছর ১৫ আগস্ট তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই সবথেকে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে দেশটির নারীরা।
তালেবান সরকার গঠনের পর তাদের দেওয়া নীতির কারণে বেহাল দশায় দিন কাটাতে হচ্ছে আফগান নারীদের। আফগান নারীদের থেকে একের পর একের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এই তালেবান সরকার। এই দেড়বছরে ঠিক কী কী ঘটেছে, তাদের সঙ্গে, বর্তমানে আফগান নারীরা ঠিক কী অবস্থায় সে বিষয়ে চোখ দেওয়া যাক।
নারীদের স্কুল বন্ধ
তালেবানের অতি-রক্ষণশীল শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুরুদের নির্দেশে বেশিরভাগ হাইস্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে। অনেক মেধাবী কিশোরী ঘরবন্দি হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটছে তাদের দিন। সোহেলা নামের এক কিশোরীর কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী সোহেলা স্কুলে না যেতে পারার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার মতো অনেক কিশোরীই স্কুলে ফিরতে না পারার কষ্টে রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) অক্টোবরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফগানিস্তানে প্রাইমারির ওপরে মেয়েদের প্রায় সব স্কুলই বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান৷ এর ফলে মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ কমে গেলো৷
নারীদের চাকরিতে নিষেধাজ্ঞা
তালেবান শাসন শুরুর আগে দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের যে আন্তর্জাতিক সংযোগ তৈরি হয়েছিল, তখন নারীরা শিক্ষা ও পেশাগত সুযোগ গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। তালেবান শাসন শুরুর পরই সেই সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্র থেকে নারীদের বিদায় দেওয়া শুরু করে তালেবান সরকার। তাদের নিয়ম অনুযায়ী নারীরা কাজের জন্য ঘরের বাইরে যেতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বেশ কয়েকজন আফগান নারীর কথা প্রকাশ করেন। যারা দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু তালেবান সরকার তাদের চাকরিচ্যুত করে।তাদের বলে, যেন তাদের পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকে (বাবা, ভাই, স্বামী) তারা সিভি জমা দিতে বলে। যদিও সেই নারীরা এ বিষয়ে একমত হতে পারছে না। তাদের শিক্ষা ও যোগ্যতার বলেই তারা কাজটি পেয়েছিল, তবে কেন পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকে তাদের স্থান দিয়ে দিতে হবে। যদিও তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি এসব কথা বলার সাহস হয়ে ওঠেনি তাদের। কারণ, চারদিকেই ওঁত পেতে আছে বিপদ।
যদিও তালেবান কর্মকর্তারা বলছেন, নারীরা এখনো কাজ করছে। তবে এখনো যারা কাজ করছেন, তারা মূলত স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষা এবং বিমানবন্দরে দেখে আসা সেই নারীদের মতো নিরাপত্তাকর্মীর কাজে নিয়োজিত। এই পেশাগুলোতে নারীদেরই বেশি দেখা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে, যে নারীরা সরকারি চাকরি করতেন, তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। তবে বেতনের পরিমানও আগের তুলনায় অতি সামান্য।
নারীদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
তালেবান সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কোনো পুরুষ আত্মীয় ছাড়া একা গাড়িতেও উঠতে পারবে না আফগান নারীরা৷ আফগান নারীরা যদি সড়কে বেশি দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে চায়, তাদের সঙ্গে পুরুষ আত্মীয় থাকলে তবেই একমাত্র তাদের পরিবহন সেবা দেওয়া হবে। অন্যথায় তারা পরিবহন সেবা পাবে না।
নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো নারী যদি ৭২ কিলোমিটার বা তার বেশি দূরত্বে যেতে চান, তাহলে তার সঙ্গে কোনো পুরুষ আত্মীয় থাকতেই হবে। এছাড়াও তাদের নির্দেশিকায় বলা হয়, নারীরা হিজাব না পরলে তাদের ট্যাক্সিতে নেওয়া যাবে না।
টেলিভিশন নাটকে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ
আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নারী অভিনীত নাটক ও বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সংবাদ পাঠের সময় নারী সাংবাদিকদের হিজাব পরার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভেঙে দেওয়া হয়েছে নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়
২০০১ সালে নারীদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় খুলেছিল তখনকার সরকার৷২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে সেই মন্ত্ণালয় বন্ধ করেছে তালেবান৷ ওপরের ছবিতে কাবুলের এক বেকারির সামনে দরিদ্র নারীদের মধ্যে রুটি বিতরণের দৃশ্য৷ রুটি দিচ্ছেন এক সাধারণ নাগরিক৷
তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক নিজেদের জায়গা হারিয়েছেন আফগান নারীরা। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর আগে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করার অনুমোদন দেয়নি তালেবান সরকার। এবার এক বছরেই তালেবান সরকারের এতসব নিষেধাজ্ঞা নিকট ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে, সে বিষয়ে যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ
নতুন নিষেধাজ্ঞায় নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ করলো তালেবান । বুধবার (২১ ডিসেম্বর) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। আফগান বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করেছে তালেবান সরকার। ইতোমধ্যে সেগুলোতে নারী শিক্ষা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে চিঠি ইস্যু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা বহাল থাকবে।
শুরু থেকেই তালেবানের নারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় সমালোচনার শিকার হন তালেবান সরকার । আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সচেতন মহল শঙ্কা প্রকাশ করছেন আফগানিস্তানে নারীদের টিকে থাকা নিয়ে , স্বাভাবিক জীবনযাপন নিয়ে। তালেবান সরকার আর কত নারীদের অধিকার কেড়ে নেবে পুরো বিশ্বে এখন যেন তাই আলোচনার বিষয়।