Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবার অ্যাসিড ছোড়া: অপরাধীর কঠোর শাস্তি হোক

একজন তরুণীকে ঠিক কতটা ‘ভালোবাসলে’ তার ‘পিয়ামুখচন্দা’ অ্যাসিড মেরে চিরকালের জন্য পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে? মোনা লিসাকে কতটা ভালোবাসলে, দ্য ভিঞ্চির চিরন্তন সৃষ্টি নষ্ট করে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে? কতটা অ্যাসিড আক্রমণ নিয়ে আমার প্রশ্ন পুরুষদের কাছে৷ কী চায় পুরুষরা নারীদের কাছে, কিভাবে চায় যে, তা না পেলে পুরুষের মাথায় খুন চাপে, শয়তান এসে ভর করে?

অন্য মানুষ কিংবা জন্তুকে কষ্ট দেওয়ার, ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি দেওয়ার যত অমানুষিক, জান্তব প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি থাকতে পারে, মনুষ্য জাতি এতদিনে তার সব ক’টি আবিষ্কার করে ফেলেছে, বলে ধরে নেওয়া যায়৷ কিন্তু যে কিশোরী বা তরুণী প্রতিদিন সপ্রতিভ মুখে পাড়া আলো করে ফুটপাথ ধরে স্কুল, কলেজ কিংবা কাজে যায়; যা-কে আপনার অনেকদিন ধরেই যেন একটু বেশি ভালো লাগে; যা-কে নিয়ে জীবনে এই প্রথমবার আপনার মতো ফুটবলপাগলের মনেও নিঃসঙ্গ, নির্জন দ্বিপ্রহরে কুবো পাখি ডাকে; সেই মেয়েটি শুধু আপনার হলো না বলে কিংবা আপনার শত্রু বলেই তাকে অ্যাসিড মেরে শাস্তি দিতে হবে?

নারীরা সকালে বাসা থেকে বের হয়ে এই ব্যাপারেও নিশ্চিত না যে, সে ঠিকঠাক বাসায় আবার পৌঁছাতে পারবে কি না। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীরা জীবন যাপন নয়,জীবনধারণ করছে। জীবনের নিশ্চয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে আজকে। নারীদের প্রতি সহিংসতা যেন থামছেই না। বাল্যবিয়ে, যৌতুক, ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ এই সমস্যাগুলোর কোনো সমাধানই যেন মিলছে না।

গত ১০ বছরে বাংলাদেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। তবে বেড়েছে নারীর ওপর অন্য ধরনের সহিংসতাও বেড়েছে। গবেষণায় বলছে, ২০০২ সালে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। যার সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০০টির মতো। তবে ২০০৯ সাল থেকে এর পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। ২০১৮ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮টিতে। ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২২ জন। ২০১৮ সালের পর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে পুনরায় ঘটলো অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো নিন্দনীয় ঘটনা। খুলনার কয়রায় ঘুমন্ত অবস্থায় গৃহবধূর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করেছে দুর্বৃত্তরা।

এত বছর পর আবার অ্যাসিড আক্রমণ কেন? এ দায়ভার কি শুধু অপরাধীর? নাকি আমাদের সমাজ ও আইন ব্যবস্থার ওপর ও বর্তায়। অ্যাসিডের সহজলভ্যতাকে এই অপরাধের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। কিন্তু মূল্যবোধের অভাব বা নৈতিক অবক্ষয় অপরাধের মূল কারণ। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অধিকাংশ অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে থাকে প্রেমঘটিত কারণে। একজন তরুণের মনে তরুণীর প্রতি প্রেম আসা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ওই তরুণীর তাকে ভালো না ও লাগতে পারে। আর এই প্রেম প্রস্তাবে যদি তরুণী রাজি না হয়, তাহলে উত্ত্যক্ত করা বা জেদের বশে অ্যাসিড নিক্ষেপ করার মতো অপরাধ ঘটায়। আবার অনেক সময় যৌতুকের কারণেও অ্যাসিড ছোড়া হয়। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় একটি বিষয় হলো, অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা সাধারণত নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে বেশি হয়ে থাকে। নগরাঞ্চলে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে এর প্রভাব খুব কম। সাধারণত ১৮ বছর বয়সের নারীরা এ সন্ত্রাসের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি।

২০০৯ সালের পর অ্যাসিড নিক্ষেপের হার কমে আসার কারণ আইনের কঠোরতা। আইনের কঠোর ও যথাযথ প্রয়োগে অপরাধীরা চলে গিয়েছিল আড়ালে। মানুষ মাত্রই মৃত্যুকে ভয় পায়। আর অ্যাসিড ছোড়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধী পেতো কঠিন সাজা। তাহলে কি এখন অপরাধীর প্রতি আইনের প্রয়োগে শিথিলতা এসেছে? না কি অপরাধীরা বেড়ে উঠছে কোনো বড় গাছের ছত্রছায়ায়? আমাদের সমাজব্যবস্থাও কি এই দায় এড়াতে পারবে?

অ্যাসিড আক্রমণ শুধু ওই নারীই নয়, আমার-আপনার সবার জীবন বদলে দিচ্ছে, মানুষের প্রকৃতি, তার ভাবনা-চিন্তা, তার চেতনা, তার মধ্যে স্নিগ্ধ, নান্দনিক, মনুষ্যোচিত যা কিছু আছে, তাকে বদলে দিচ্ছে৷ দেখুন, টেলিভিশনে কোনো অ্যাসিডে পোড়া তরুণীর মুখ দেখালে আমরা ‘নিরপরাধ’ দর্শকরা–কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়–‘জীয়ল গাছের আঠার মতো কষ্ট পাই মুখ ফিরিয়ে নিই/ কিংবা রিমোট টিপে চ্যানেল বদল করি?’

কেমন লাগে অ্যাসিড মারতে? ফুলের ওপর অ্যাসিড মেরে দেখতে পারেন–ফুল পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, এই যা রক্ষা৷ নয়তো ও পোড়ার দাগ কোনোদিন ঘুচবে না–মেয়েটির মুখেও নয়, আপনার মনেও নয়, যদি এই ঘটনার পর আপনার মন বলে কিছু থাকে৷

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ