Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী মুক্তিযুদ্ধোরা কতটা স্বীকৃতি পেয়েছেন?

জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।’
-কাজী নজরুল ইসলাম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় যথার্থই বলেছেন। এই পৃথিবীর প্রতিটি মহৎ কাজে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু নারীর সেই অবদান কোথাও লেখা থাকে না। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধেও তেমনি নারীর রয়েছে বীরত্বপূর্ণ অবদান। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও নারীদের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর অবদান বিশদ আলোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। নারী তার সব সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ ও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন নারীরা।

অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদানকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ক্ষেত্রে নিপীড়নের অগ্নিসাক্ষী বা লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মা-বোন নামেই প্রচার হয়েছে বেশি। আর এ কারণেই সম্ভবত রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষিকারা মঞ্চে উঠেই অনর্গল বলতে থাকেন, ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। যুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা আমাদের অনেক বড় সহায় শক্তি ছিল- একথা অনেকেই ভুলে গেছেন। পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য এদেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সকল শ্রেণিপেশার মানুষ সম্মিলিতভাব মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

নারীরা কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়েছেন, আবার কখনো যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। দুঃসাহসী নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। বহু নারী আছেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেবা করেছেন, অনাহারী-অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কখনো মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনো বোনের মতো। নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন। মু

ক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধ।

যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেকোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সেক্ষেত্রে নারীদের ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। মুক্তিযুদ্ধে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য।

প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, শুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরো অনেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এগুলো প্রচারণায় এসেছে। আরো কত কাহিনী আছে যা রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। মুক্তির গান সিনেমাটা দেখলে আরো অনেক বিষয় স্পষ্ট হওয়া যায়। ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন কলকাতায় বসে মুক্তিদ্ধের রণাঙ্গনে গানের টিম পাঠিয়ে উদ্দীপ্ত করতেন যোদ্ধাদের। এ কাহিনি কজনইবা জানে!

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভাগীরথীর নাম স্বর্ণক্ষরে লেখা থাকবে। তার ওপর নেমে আসা জুলুম দুনিয়ার আর কোথাও কোনো নারী ভোগ করেছে কি না, সন্দেহ। যুদ্ধের সময় তিনি ছদ্মবেশে গুপ্তচরের কাজ করতেন। একাত্তরের মে মাসে পিরোজপুরের বাগমারা কদমলি গ্রামে হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিধবা ভাগীরথীকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে পাশবিক নির্যাতনে জর্জরিত করে। এক সময় মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে পাকিস্তানি সেনাদের মন জয়ের কৌশল গ্রহণ করেন। তাতে সুবেদার সেলিম তাকে গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এনে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভাগীরথী দেবী সাহায্য করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। বিভ্রান্তিকর খবর দিতেন পাক বাহিনীকে। আর সে অনুযায়ী গিয়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়তো পাকিস্তানি সেনারা। এর প্রতিশোধ নিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ভাগীরথী দেবীকে।

বীরপ্রতীক তারামন বিবি, সেতারা বেগমের ত্যাগের কথাও আমাদের জানা। বীরাঙ্গনা রিজিয়া খাতুন, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী একেক জ্বলন্ত অগ্নিকন্যা। আইভি রহমান, এসেম আনোয়ারা বেগম, মালেকা বেগম, বাসন্তী রানী, নীলিমা ইব্রাহিম এরকম হাজারো নারী কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করে গেছেন দেশ মাতাকে মুক্ত করতে। তাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়।

নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা ও শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারীশিল্পী। তাছাড়া যুদ্ধ চলাকালে অনেক নারী কবি, লেখক, সাংবাদিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন দেশ স্বাধীন করার কাজে। তাদের লেখায় ও শিল্পীদের গানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। শাহনাজ বেগমের কণ্ঠে ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’, কল্যাণী ঘোষের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’- এ রকম অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক বাঙালি নারী। তাদের মধ্যে কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, রওশন আরা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব নারী সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং। যেমন, সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং, অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনেক নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন।

প্রাণ বিপন্ন জেনেও যেসব স্ত্রী, মাতা, বোন-কন্যারা প্রাণপ্রিয় স্বামী, পুত্র, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, তাদের এ মহানুভবতার উৎসও অবশ্যই দেশপ্রেম। এক্ষেত্রে শেখ ফজিলাতুন্নেছার নাম সর্বাগ্রে। এছাড়া বেগম সুফিয়া কামালসহ হাজারও নাম না জানা নারী যোদ্ধা ছিলেন। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। পুরুষের পোশাকে এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল, আলেয়া বেগম।

শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম বা শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মাই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে সর্বমোট ৬৭৬ বীর যোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন নারীও রয়েছেন। একজন হলেন ডা. সেতারা বেগম, অন্যজন হলেন তারামন বিবি; যাদের ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব দেওয়া হয়। বাঙালির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাই তাদের এই অবদানকে যথাযথভাবে সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ