Skip to content

৫ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেগম রোকেয়া: নারী জাগরণের অগ্রদূত

বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ ছিল; তখন নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে।

পায়রাবন্দ জমিদার পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়া শেখার সমস্ত রাস্তা ছিল বন্ধ। তার বাবা আবু আলী হায়দার সাবের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। তার পরিবার যেটুকু উদারতা দেখিয়ে এসেছে, তা শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। বেগম রোকেয়া ছেলেবেলা থেকে দেখেছেন মুসলিম সমাজ কখনো স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়নি। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি শক্ত হাতে ধরেছিলেন কলম। বাংলা ভাষা শিক্ষা যে পরিবারে নিষিদ্ধ ছিল, সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, বাংলাকেই মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করলেন বেগম রোকেয়া। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ও বোনের সহযোগিতায় গোপনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করেন।

১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন উদার ব্যক্তি। স্বামীর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণেই রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের লেখকদের রচনার সঙ্গে পরিচিতি ঘটতে থাকে। ১৯০৯ সালে স্বামী মারা গেলে বেগম রোকেয়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। স্বামীর নামে গড়ে তোলেন মেয়েদের স্কুল। ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’-এর যাত্রা শুরু করেন ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। ধীরে ধীরে বাড়ে স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা। এ নিয়ে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি রোকেয়াকে। পদে পদে পেয়েছেন বাধা। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। মেয়েদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসাই ছিল তার স্বপ্ন।

সাহিত্যেও কাজ করেছেন নারীদের পক্ষে। ১৯০২ সালে নভপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পান। ১৯৫০ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সুলতানাস ড্রিম’ যার অনূদিত রূপ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের মাধ্যমে সর্বজন পরিচিত হয়ে ওঠেন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থ হলো, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্যদিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তোলেন।

বাঙালি মুসলমান সমাজে বেগম রোকেয়ার আগে আর কারো নাম সেভাবে পাওয়া যাবে না লেখিকা হিসেবে। শুধু মুসলমান সমাজ নয়, রবীন্দ্রযুগের বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। বেগম রোকেয়াই প্রথম সমাজ ভাবনায়, সাহিত্য সাধনায় অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রোকেয়ার একটা স্বতন্ত্র জায়গা থাকবে। বেগম রোকেয়া তার লেখনীতে স্ত্রীজাতির অবনতির কারণগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলতে পারি নাই, তাহার কারণ এই বোধ হয় যে, যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছে, তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে’। তিনি বলেছেন, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন’। ‘নিরীহ বাঙালি’ নামে এক প্রবন্ধে রোকেয়া বাঙালির চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য এবং সহজ কার্যসিদ্ধির এই যে প্রবণতা তার কারণ কী তা বলেছেন- রাজ্য স্থাপন করা অপেক্ষা রাজা উপাধি লাভ সহজ।

মতিচূরের প্রবন্ধগুলোতে তিনি নারী-পুরুষের অসম অবস্থার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন। অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না। সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণে) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।

বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অবরোধবাসিনী। অবরোধবাসিনী গ্রন্থে ৪৭টি অবরোধ কাহিনী তুলে ধরেছেন তিনি। পর্দার নামে যে অবরোধপ্রথা সমাজে চলে এসেছে, সে সম্পর্কিত রচনা। তীব্র জ্বালায়, ক্ষোভে, দুঃখে রোকেয়া এই রচনায় কৌতুক করেছেন এই প্রথার বিরুদ্ধে। আজকে মুসলমান সমাজে এবং দেশে নারীশিক্ষার বিকাশ ঘটেছে, মেয়েরা কর্মজীবনের নানাক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে, কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। বাংলাদেশের নারীদের সামগ্রিক অবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, নারীর সত্যিকার মুক্তি এখনো আসেনি। পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন, নিরাপত্তাহীনতা, যৌতুক, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক সত্ত্বেও নারীদের সংগ্রামী ভূমিকা উজ্জ্বল। তারা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের এই সাহস, শক্তি ও প্রেরণার মূলে রয়েছে বেগম রোকেয়ার আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা। স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? আমরা দাসী কেন’? সুলতানার স্বপ্ন গল্পে বেগম রোকেয়া গল্পচ্ছলে নারী স্বাধীনতার কথা বলেছেন।


মুক্তিফল বেগম রোকেয়ার রূপকথা হলেও সেখানে তিনি নারী অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল মূলত দুই ধরনের, একদিকে ঘুমন্ত নারী সমাজকে জাগিয়ে তোলা। যা তার সুবহে সাদেক প্রবন্ধে প্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে, সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। তার এ সংগ্রাম কখনও পুরুষের বিরুদ্ধে ছিল না বরং নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তনই ছিল তার কাম্য। দাসী নয়, সহধর্মিণীরূপে, সহযোদ্ধারূপে পাশে রাখাই ছিল তার আহ্বান। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই। সুব্হে সাদেক প্রবন্ধে তিনি নারীদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন-“বল আমরা পশু নই, বল ভগিনী আমরা আসবাব নই, বল কনে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকবার বস্তু নই, সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ!” আমরাও যে মানুষ এটাই বড় সত্য, আর এ বড় সত্যকে সত্যরূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মূলত রোকেয়ার আমৃত্যু সংগ্রাম ও সাধনা।

বেগম রোকেয়া তার লেখার মাধ্যমে, সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে হাজার নারীর মাঝে তার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার অনুপ্রেরণামূলক কাজ বর্তমান নারীদের এতদূর নিয়ে এসেছে। নারীদের কাছে একজন অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্ব। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ অবধি সমাজের সর্বস্তরে, ঘরে বাইরে নারীকে নারী নয়, মানুষরূপে মূল্যায়ন করার যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে শিক্ষা, যে আচার আচরণ প্রয়োজন তা গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি রোকেয়ার স্বপ্নের সেই মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ, যে সমাজে আমরাও মানুষ হয়ে উঠব। তাই রোকেয়া দিবস রোকেয়াকে স্মরণকালে এমন এক সমাজ গড়ে তোলাই হোক আজ আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ও কাম্য। তবেই রোকেয়া দিবসের সার্থকতা ও মর্যাদা ছড়িয়ে পড়বে সমাজের সর্বস্তরে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ