Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাত্র-রাজনীতিতে মেয়েদের অধিকার কতটুকু

শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকাই ছাত্র-রাজনীতির আদর্শ হওয়া উচিত। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। ২০ শতকের প্রথম ভাগে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়।

১৯ শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের লক্ষ্যে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে আনন্দমোহন বসু ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদানের আহ্বান জানান এবং ছাত্রদের রাজনীতি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, বিশেষত স্কুল ও কলেজ কতৃপক্ষের কড়া শাসন ছিল ছাত্রদের রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা। এছাড়া উনিশ শতকের শেষ ভাগের পূর্ব পর্যন্ত ঔপনিবেশিক সরকারের একটি চাকরির জন্য কিছুটা বিদ্যার্জন ছিল সব শ্রেণির ছাত্রের উচ্চাভিলাষ।

অতীত থেকেই ছাত্র রাজনীতি দেশের কাজে অনেক অবদান রাখছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসবের একটা বড় অংশে অবদান ছাত্রদের। আর ছাত্র রাজনীতিতে পিছিয়ে নেই মেয়েরাও। রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা এখন সক্রিয়।

আধুনিক ব্যক্তিমানুষের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা খুবই স্বাভাবিক। রাজনীতিই জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। ফলে মানুষ হিসেবে নারী রাজনীতিবিচ্ছিন্ন কোনো জীব নয়। রাজনীতির মূল বিষয় হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা ও ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হলো রাজনীতি। ক্ষমতা অর্জন ও বজায় রাখার সংগ্রাম, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রয়োগ বা তার প্রতিরোধমূলক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। এই কারণে ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা সমাজ ও রাষ্ট্রের সব সম্পদের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রধান চাবিকাঠি। ফলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ মানে হচ্ছে ক্ষমতাকাঠামোর সেই জায়গায় আরোহণ, যেখানে জনগণের জন্য সম্পদের মালিকানা বণ্টন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়।

অথচ শ্রেণি, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কারণে নারীরা আজও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণ থেকে অনেক দূরে। ফলে দৃশ্যমান রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বা প্রতিনিধিত্ব গৌণ কিংবা অদৃশ্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, বিরোধীদলের প্রধান নারী, স্পিকার একজন নারী। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নারী।

বর্তমান সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের বাইরে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য আছেন ২০ জন। অর্থাৎ রাজনীতিতে বর্তমানে নারীদের অবস্থান অনেকটাই সক্রিয়। বাংলাদেশের সূচনা লগ্ন থেকেই নারীরা রাজনীতিতে জড়িত। অন্দরমহল থেকে দেশের কাজে নিয়োজিত হতে রাস্তায় নেমেছেন অনেক নারীই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাইয়েছেন, তাদের সেবা করেছেন। অনেকেই ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি যুদ্ধও করেছেন।

বর্তমান দুনিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের নানা প্রসঙ্গে কথা বলা হলেও এটা এখন প্রায় স্বীকৃত যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া নারীর পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। জাতিসংঘ বলছে, রাজনীতিতে কিংবা সরকারে অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামোতে বা আইনসভায় নারীর অংশগ্রহণ মানে আবশ্যিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকা বদলে দেওয়া, লৈঙ্গিক প্রেক্ষাপটে নতুন মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার আলোকে মূলধারার রাজনীতিতে বহুমাত্রিকতা যুক্ত করতে পারা।

নারীর রাজনীতির প্রশ্নে দার্শনিকদের মধ্যে দুই ধরনের বিতর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদল মনে করে, পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ নারীকে প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল ও নিম্নমানের বলে চিহ্নিত করে অরাজনৈতিক করে তোলে এবং ক্ষমতাহীন করে গৃহে আবদ্ধ রাখে। এ রকম অবস্থায় আইন করে বা আইনের সংস্কার করে নারীকে গৃহের বাইরে হয়তো আনা সম্ভব হয়; কিন্তু পাবলিক পরিসরে পুরুষের ক্ষমতা কখনোই আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয় না।

আবার আরেক অংশের মতে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পুরুষদের বস্তুগত ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে এবং মতাদর্শিক প্রবলতার সঙ্গে বস্তুগত প্রাচুর্যের মিলনে পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা পুনরুৎপাদিত হয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুরুষের রাজনীতি এভাবে সর্বজনীনতা লাভ করে। মতাদর্শিকভাবে অধস্তন হয়ে এবং আর্থ-সামাজিকভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে শুধু ভোট ও আইনের কাগুজে অধিকার নিয়ে নারীর পক্ষে পুরুষের রাজনীতির দুনিয়ায় প্রবেশ করা এবং তার ক্ষমতার দুর্গে আঘাত হানা প্রায় অসম্ভব।

বিশ্বপরিসরে এবং আঞ্চলিক পর্যায়েও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনীতিতে নারীর অধস্তনতা ও প্রান্তিকতা সারা দুনিয়ায়ই বিদ্যমান। তবে নারী আন্দোলন ও তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষার প্রসার, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আগ্রহ, সচেতনতা ইত্যাদির প্রেক্ষাপট সব সমাজে সমান নয়। শিল্প অর্থনীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নারীর মর্যাদা উৎপাদক হিসেবে হ্রাস পায়; এমনকি লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজন পাকাপোক্ত হয়, যা পুরুষতন্ত্রের বিভাজিত ব্যবস্থার সঙ্গেই সম্পর্কিত। ফলে পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য আর নারীর অধস্তনতা সত্যে পরিণত হতে থাকে।

আজও যার প্রভাব অব্যাহত আছে। এমন বাস্তবতায়, রাজনৈতিক অঙ্গন নারীর জন্য আরো কঠিন হয়ে সামনে আসে। বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর পদচারণ সরব এবং সক্রিয় হয়ে উঠলেও নারী এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে পারে—এমন অবস্থানে আসতে পারেনি। প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় শুধু নয়, সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণও খুবই নগণ্য। বিশ্বব্যাপী নারী আজও পুরুষের মতো পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। বৈশ্বিকভাবে নারী নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে, তবে এর পরিমাণ ও গুণগত অবস্থান খুব পরিবর্তন হয়েছে বলা যাবে না।

বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র, যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ন্যূনতম চর্চাও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। ধর্মের প্রভাব রাজনীতিতে প্রবল, সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জাঁতাকলে বারবার পিষ্ট এবং যেখানে আজও মানুষের মৌলিক অধিকারের রাজনীতিই প্রতিষ্ঠা পায়নি, সেখানে নারী আন্দোলন ক্রমে জোরালো হয়ে উঠলেও তা কখনো নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হতে পারেনি।

মূলত তা বারবারই ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছে। তাই আন্দোলন-পরবর্তী সময়ের নির্বাচনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা দাবিদাওয়া কখনো কোনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়নি। ফলে রাজনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেলেও আন্দোলনের মাধ্যমে নারী অধিকার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হয়ে ওঠেনি। এসব কারণেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নারীর রাজনীতি কিংবা রাজনীতিতে নারী সাম্প্রতিককালের প্রপঞ্চ বলে মনে হতে পারে; এমনকি নারী আন্দোলনকর্মীরা আজও নারী অধিকার সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে একটি ঐক্যবদ্ধ মোর্চা পর্যন্ত গঠন করতে সক্ষম হননি।

একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ ও বিনির্মাণে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন, সুধীসমাজ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ইত্যাদির পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিসরে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই রাজনীতিতে নারীর থাকতে হবে সমান অধিকার।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ