আলালের ঘরের দুলাল: আবহমান নারীর রূপায়ণ
ডিরোজিও ভাবধারাপুষ্ট ও ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর অনুগামী প্যারীচাঁদ মিত্র (২২ জুলাই ১৮১৪-২৩ নভেম্বর ১৮৮৩) বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস সৃষ্টির সুপ্রচেষ্টা যদিও সার্থক উপন্যাস স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্যারীচাঁদ মিত্র টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। তার উনিশটি গ্রন্থের মধ্যে এগারোটি গ্রন্থ বাংলা শিল্প-সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে নকশা জাতীয় যেসব রচনা প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সমধিক উপন্যাসের লক্ষণাবিষ্ট। জীবনের নানামুখী জটিলতা এখানে স্থান পেয়েছে। আলালের ঘরের দুলাল রচনাটিতে নকশা জাতীয় গ্রন্থের কাহিনির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে গিয়ে লেখক তৎকালীন কলকাতার একটি পরিবারের উত্থান-পতন, তাদের জীবনযাত্রা, বিদ্যাশিক্ষা, আচার-বিচার, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি দিক তুলে ধরেছেন।
‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর কাহিনিতে ত্রিশটি অধ্যায় রয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শীর্ষে একটি করে ব্যাখ্যাধর্মী নাম আছে। গ্রন্থটি তৎকালীন সামাজিক পটভূমিকায় লিখিত। নব্য শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের কার্যকলাপ ও পরিণতি এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণে গা ভাসিয়ে তরুণের বিপথে যাওয়া এবং পরবর্তীকালে ভুল বুঝতে পেরে সঠিক জীবন পরিচালনা এই গ্রন্থে প্রাধান্য পেয়েছে। এই গ্রন্থের একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। বাবুরামবাবু, বাবুরামবাবুর স্ত্রী, মতিলাল, রামলাল, বরদাপ্রসাদবাবু, বেণীবাবু, বেচারাম, ঠকচাচা, ঠকচাচী , মোক্ষদা, প্রমদা প্রভৃতি।
বৈদ্যবাটির বাবুরামবাবু নানা উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে এলাকার প্রভাবশালী এবং গণমান্য বাবুতে পরিণত হয়েছে। তার দুই পুত্র এবং দুই কন্যা যথাক্রমে মতিলাল, রামলাল, মোক্ষদা, প্রমদা। মতিলাল অসৎসঙ্গে এবং ঠকচাচা প্রমুখ কুচক্রীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ধীরে ধীরে অধঃপতনের অলতে নিমজ্জিত হয়েছে। অন্যদিকে বাবুরামবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রামলাল। বরদাপ্রসাদবাবুর সান্নিধ্যে, সুনির্দেশে প্রথম থেকেই উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠেছে। মতিলালের অধঃপতন এবং সেখান থেকে সৎসঙ্গে কিভাবে জীবনের উন্নয়ন ঘটায় সেটাই আলোচ্য গ্রন্থের মুখ্য বিষয়।
কন্যাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বাবুরামবাবু প্রচুর অর্থব্যয় করে দুই কন্যারই বিয়ে দেন। কুলীন জামাতারা অনেক স্থানে দার পরিগ্রহ করায় বিশেষ পারিতোষিক না পেলে বৈদ্যবাটীর অভিমুখী হতো না। কন্যা মোক্ষদা বিধবা। এবং প্রমদার ভাগ্যে কুলীন স্বামীর স্বাক্ষাৎ ঘটে না। কুলীনরা হলো সম্ভ্রান্ত বংশজাত। তৎকালে বল্লাল সেন দ্বারা প্রবর্তিত হিন্দুকুল ও বর্ণ সমীকরণের এরূপ আইনের ফলে সমাজে কুলীন বংশজাতদের খুব মান্যগণ্য করা হতো। ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ উনবিংশ শতক পর্যন্ত বেশ কলঙ্কিত ছিল।
একজন কুলীন বংশজাত পুরুষ কুলীন বা অকুলীন যেকোনো ব্রাহ্মণ বংশেই বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যার বিয়ে হবে কেবল কীলুন বংশেই। ফলে কুলীন কন্যাদের জন্য সেসময় পাত্র পাওয়া দায় হয়ে যেত। পত্রদের ক্ষেত্রে তারা কুলীন হলেও অকুলীনজাত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতেন কিন্তু কন্যারা পারতেন না। ফলে সমাজে কুলীনদের বহুবিবাহ বাড়তে থাকে। কন্যার পিতা সামাজিকভাবে দায়মুক্ত হওয়ার জন্য যেকোনো কুলীনের সঙ্গেই চড়া পণে মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হতেন। কুলীন হওয়ার কারণে মৃত্যুশয্যায় থাকা পাত্রের সঙ্গেও কন্যার বিয়ে দিতে পিছপা হতেন না কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার। সেকারণেই সমাজে অল্পবয়সে মোক্ষদারা বিধবা।
পিতার অর্থকড়ি দিয়ে কন্যা সন্তানের জন্য কুলীন পাত্র জোগাড় করলেও সুখের স্পর্শ সেসময়ের কন্যারা পেত না। কারণ কুলীনবংশ জাত এসব পুরুষের শত শত পত্নী থাকত। ২-৩ বছর ঘুরেও হয়তো এক স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটত না। এই বিবাহবণিকেরা নিজেরদের কুলীনত্বকে পুঁজি করে অল্পবয়সী কন্যাদের সতীত্ব গ্রাস করত সেইসঙ্গে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অর্থকড়িও ভোগ করতো। যখন টাকার প্রয়োজন হতো তখনই শ্বশুরগৃহে তাদের প্রবেশ ঘটতো। ইতিহাস ঘাটলে এমনও পাওয়া যায় তাদের বিবাহের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, একটি বিবাহ সেরে স্ত্রীর নাম-ধাম, ঠিকানা খাতায় লিখে অন্যত্র গমন করতেন। সমাজের এই কালো অন্ধকারে নারীদের জীবন। যেখানে নারী শুধু পণ্য সামগ্রী।
সমাজের বিধিনিষেধের নামে কন্যাদের সঙ্গে চলতো প্রহসন। মোক্ষদা বিধবা আর প্রমদা কুলীন স্বামীর আশায় দিন কাটাত। সমাজের এই কদর্য দিক উঠে এসেছ আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থটিতে। অনেক সময় বিবাহবণিকেরা রাতে শুতে গিয়ে স্ত্রীর সব গয়না নিয়ে চম্পট দিত। এই বিবাহবণিকদের সঙ্গে বিবাহিতা কুলীন নারী যৌনতৃষ্ণা মেটাতে অনেক সময় পরপুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হত। এর ফলে অবাঞ্চিত সন্তান আর ভ্রূণ হত্যা হতো। নারীকে সমাজ মানুষ রূপেই গণ্য করা হতো না। তাদের প্রতি এভাবেই সামাজিকভাবে নারীদের ওপর দিনের পর শোষণ চলেছে।
সমাজের পরিবর্তন হয় শ্লথগতিতে। তবু হয়। যুগে যুগে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরা এসেছেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী সমাজের পক্ষে কথা বলেছেন। কৌলীন্য বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ সমাজ থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু আজও সমাজে থেকে নারীর প্রতি অবিচার- অন্যায় মুছে যায়নি। অবিচারের ভোল পাল্টেছে কিন্তু থেকে গেছে তার মূল। তাই এর বিনাশ প্রয়োজন। সে শক্তি একমাত্র নারীর হাতেই রয়েছে।
এই গ্রন্থটিতে তিনি নারীদের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তারা সবাই সমাজের শোষণের জালে বন্দি। বাবুরামবাবুর স্ত্রী সতীসাধ্বী স্ত্রী। স্বামীর অনুরক্ত হলেও স্বামী বাবুরামবাবু দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেছে। চরিত্রটি ম্লান। তার চরিত্রে নারীর জাগরণ দেখাননি লেখক। ছেলে মতিলাল স্ত্রীর প্রতি নিপীড়ন করলে তাকে অভয় দিয়ে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দেয়। এদিক থেকে তার মধ্যে মানবিক চেতনা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে ঠকচাচী স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। ধূর্ত ঠকচাচাকেও রীতিমতো বশে রাখার চেষ্টা করেছে যদিও গ্রন্থটিতে সরাসরি চরিত্রটির উপস্থিতি নেই। ফলে চরিত্রটির প্রতিবাদও যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
প্রমদা, মোক্ষদার জীবনের যতটুকু জানা যায় তাতে কৌলীন্য প্রথার চরমতম রূপ প্রকাশিত হয়েছে। নারীর জীবন যে অসহায়, অবহেলার শিকার প্রতিনিয়ত তা এই গ্রন্থের প্রতিটি নারীই বহন করেছে। মতিলালের বিমাতা এবং স্ত্রীর কোন ভূমিকা কাহিনিতে নেই। গ্রন্থটিতে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই অবন্তর হয়ে উঠেছে শুধু তাদের উপস্থিতিকে সঠিকভাবে বুননের অভাবে। কাহিনির মধ্যে নারীদের যেভাবে রূপায়ণ করা হয়েছে তাতে নারীর ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস পাঠককে চিরন্তন নারী সত্তাকে স্মরণ করায়।
নারী যুগ যুগ ধরে শোষণ-বঞ্চনার শিকার। কুলীন প্রথা-সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটলেও নারী শোষিত হচ্ছে নতুনরূপে। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের ভাগ্য নারীকেই পরিবর্তন করতে হবে। আলালের ঘরের দুলালে প্যারীচাঁদ মিত্র বৈসাদৃশ্য কাহিনি, ক্রমপরিণতিহীন ঘটনাবিন্যাস, অবিকাশিত চরিত্র, ব্যক্তিত্বহীন নায়ক এবং অবাস্তব নারী চরিত্র এবং প্রণয় রসহীনতার কারণে সার্থক উপন্যাসের মর্যাদা পায়নি। নীতিকথা প্রচারই যেন লেখকের কাছে মুখ্য ছিল। ফলে সার্থকতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে৷ তবু উপন্যাস সাহিত্যের জগতে লেখকের সূচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাকে অমরত্ব দান করেছে।