হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’: নারী নিপীড়নের চিরায়ত ছবি
হাসান আজিজুল হক (২ ফ্রেব্রুয়ারি১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক । ষাটের দশকে শিল্প-সাহিত্যে আর্বিভূত হয়ে লেখক তার নিজস্ব ভাষা-রচনা পদ্ধতির বলে পাঠক মনে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ গল্পটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যাঙ্গনে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। এরপর পাঠককে উপাহার দেন একের পর এক সফল গল্প।
হাসান আজিজুল হক সমাজ থেকেই তার লেখার উপকরণ গ্রহণ করেছেন। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের জীবনের কথা তার উপন্যাস-গল্পের ভাষ্য হয়ে উঠেছে। তাই তিনি নিমিষেই পাঠকের অন্তরে স্থান করে নিতে পেরেছেন আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।
হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’ গল্পটির প্রেক্ষাপট ঘুণে ধরা সামজের শোষণের চিত্র। যে সমাজে নারীরা নিরাপদ নয়। যেই সমাজে দরিদ্ররা প্রতিনিয়ত আরও দারিদ্র্যের শিকার। পুঁজিপতি সমাজের কষাঘাতে নিম্নবর্গের জীবন দুর্বিষহ। শকুন যেমন পচা আবর্জনা ঠুকরে খায়, রোগাক্রান্ত, মৃত প্রাণী নিমেষেই সাবাড় করে দেয়। সমাজের মোড়ল, মাতবর, রাঘববোয়ালেরা তেমনই হতদরিদ্র মানুষের বুকে পা দিয়ে তার সর্বস্ব শুষে নেয়। এই জুলুম-অত্যাচার-নিপীড়নের চিত্রের এক অনবদ্য রূপ ফুটে উঠেছে ‘শকুন’ গল্পে।
সাধারণ গল্পের ভূমিকায় গল্পটি না এগিয়ে একটু ভিন্নখাতে লেখক গল্পটির বর্ণানা দিয়েছেন। প্রথম পর্যায়ে শুধু শকুনকে নিয়েই কিছু গ্রাম্য বালকের উৎসাহ, উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। কিন্তু গল্পটি যত এগুতে থাকে তত শকুনের মতোই শোষিত রূপ অত্যাচার-নিপীড়নের চিত্র উঠে আসতে থাকে সামনে। তবে গল্পের শেষবাক্যে গিয়ে লেখক নারী জীবনের পরিণতি, ঘুণে ধরা সমাজের চিত্র, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের জীবনকে একদাগে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। রূপায়ণ করেছেন সামাজিক অবক্ষয়ের নিটোল চিত্র।
‘শকুন’ গল্পের সূচনা কয়েকটি গ্রাম্য বালককে কেন্দ্র করে। যারা সন্ধ্যার পর তেঁতুল গাছের দিকে পেছন ফিরে বসেছিল। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল সবাই। হঠাৎ তেঁতুল গাছের একটি শুকনো ডাল নড়ে উঠতেই তাদের মধ্যে ভয় চেপে বসে। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল অন্ধকারের মতো প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে কী যেন চলে যায়। সবাই হৈ চৈ করে ওঠে।
কিছুক্ষণ পর তারা বুঝতে পারে একটি শকুনি। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতে পারেনি। রাতকানা শকুনিটি ধরে ফেলে গ্রাম্য রাখাল বালক জামু, রফিক, পল্টু। শকুনিটির গায়ে দুর্গন্ধ। ভাগাড়ের আঁশটে গন্ধ, গলিত শবদেহের পচা পাঁক শকুনিটির গায়ে মাখানো। অনেক কষ্টে তারা শকুনিটি কব্জায় আনে। শকুনিটিকে কেন্দ্র করেই তাদের সংলাপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে গল্প। বালকেরা নানান কথা বলে, হাসিতামাশা করে শকুনিটিকে ধরতে পেরে। সময় পেরুতে থাকে নানান কথকতায়।
শকুনকে দেখে গ্রাম্য রাখাল বালকদের হিংসে হয়। মনে হতে থাকে তাদের খাবারই যেন শকুনি খেয়ে ফেলে। মহাজন যেমন করে তাদের ভাগ্যে জুটতে দেয় না দুবেলা দুমুঠো ভাত, একটুকরো কাপড়! সেই আদিমতম বর্বরতার রূপ যেন ফুটে উঠেছে এই শকুনিটির মধ্যে দিয়ে। গল্পে পাই, ‘ছেলেদের কথায় শকুনিটাকে দেখে তাদের রাগ লাগে, মনে হয় তাদের খাদ্য যেন শকুনির খাদ্য, তাদের পোশাক যেন ওর গায়ের বিকৃত গন্ধভরা নোংরা পালকের মতো, সুদখোর মহাজনের চেহারার কথা মনে হয় ওকে দেখলেই।’
বালকেরা শকুনকে মহাজনের সঙ্গে তুলনা করে। যে মহাজন তাদের একবেলা পেটপুরে ভাত খেতে দেয় না। বালকদের চোখে লেখক শকুনের প্রতীকে তুলে ধরেছেন সুদখোর মহাজনের শ্রেণিশোষণের চিত্র। শকুনের গায়ের পালক তুলে নেওয়ার মতোই যেন সমাজের সব ব্যবধান উপড়ে ফেলতে চায় হতদরিদ্র বালেকেরা। শোষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সংঘবদ্ধ হয়ে অতি শক্তিশালী শকুনের মতো মহাজনকেও আষ্টেপৃষ্টে ধরতে হবে।
মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই লেখকের যেন এই এক অভিনব ডাক। শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরা মানুষের হৃদয়ের হাহাকার।
শকুন গল্পটির মধ্যে যেমন লেখক শ্রেণি-বৈষম্যকে তুলে এনেছেন, তেমনই তুলে ধরেছেন চিরায়ত নারীর প্রতি অত্যাচারের চিত্র। নারী যেন সমাজের মাঝে অবাঞ্ছিত। তাই যখন খুশি যেভাবে খুশি শোষকশ্রেণি তাকে ভোগ করতে পারে। নারীর শরীর যেন শুধু যৌনবাসনাকে তৃপ্ত করার জন্যই । এই হীনচেতা মানুষের ভোগের শিকার বিধবা এক নারী। যার জীবনের করুণ দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন লেখক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভাগ্যবিড়ম্বিত কাদু শেখের বিধবা বোন।
রাতে যখন বালেকেরা গ্রামের পথ দিয়ে ঘরে ফিরছে তখন লক্ষ করে দূরে তালগাছের ওপাশে ন্যাড়া বেলগাছের যে ছোট তোরাণ আছে তার পাশে সাদা আবছা কী যেন চোখে পড়ে। বালকেরা কৌতূহল বশত ওদিকে যেতে চাইলেও জামু সবাইকে নিবৃত্ত করে। অন্যপথে বাড়ি ফেরার আহ্বান জানায়। পরদিন সকালে সাবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে একটি মৃত নবজাতকের ওপর। জামু ও অন্যবালোকেরা লক্ষ করে গত রাতে প্রহার করা শকুনিটি পড়ে আছে। আরও অনেক শকুন সেখানে পাক দিয়ে নামছে। শকুন তো শকুনের মাংস খায় না, তবে কেন এদের উৎপাত!
শকুনিটির কিঞ্চিৎ দূরেই পড়ে আছে একটি নবজাতক। শকুনিটি মরে আছে, সেখানে কিভাবে আসলো নবজাতক? সবার চোখে কৌতূহল। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে মানুষ ডেকে আনছে মৃত শিশুটি। গল্পে পাই, ‘ই কাজটো ক্যা করল গা? মেয়ে-পুরুষের ভিড় জমে গেল আস্তে আস্তে। এলো না শুধু কাদু শেখের বিধবা বোন। সে অসুস্থ। দিনের চড়া আলোয় তাকে অদ্ভুত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে মরা শকুনিটার মতোই।’
নারীকে সমাজ পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারে না। ব্যবহার করে পণ্যের মতোই। বিধবা কাদু শেখের বোন তার সম্ভ্রম জলাঞ্জলি দিয়েছে জমিরদ্দির কাছে। তার লালসার শিকার হয়ে জীবনকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার মুখে। সমাজিকতা মেনে জমিরদ্দি কাদু শেখের বোনকে ঘরে তোলেনি কিন্তু লালসার সর্বোচ্চ বীজটিও তার গর্ভে দিয়েছে।
যুগ যুগ ধরে নারীরা জমিরদ্দিদের লালসার শিকার। বুকের হাহাকারকে জলাঞ্জালি দিতে হয়েছে রাতের আঁধারে, ঝোপের নির্ভরতায়। মৃত মানব শিশু স্থান পেয়েছে মৃত শকুনির পাশে। নারীর প্রতি অত্যাচার যেমন ফুটে উঠেছে তেমনই উঠে এসেছে নারীর অসহায়ত্ব। সমাজের ভয়ে নিজের নবজাতক শিশুটিকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে কাদু শেখের বোনকে। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে সমাজই যেন সর্বোচ্চ শৃঙ্খল! লেখক এই গল্পে জমিদার শ্রেণির শোষণ, সমাজে নারীর অবস্থান, অসহায়ত্ব, বিধবা নারীর জীবনের করুণ পরিণতি তুলে ধরেছেন।
নারীদের অবস্থানের কোনোই পরিবর্তন আজও পরিলক্ষিত হয় না। সমাজ আজও নারীদের ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার করে চলেছে। কাদু শেখের বিধবা বোন সমাজের ভয়ে নিজের ওপর পাশবিক অত্যাচারকে যেমন মুখ বুজে সয়ে গেছে ঠিক তেমনই একজন একা নারী সমাজে কতটা অসহায় তারও করুণ চিত্র উঠে এসেছে এই গল্পে।
হাসান আজিজুল হকের ষাটের দশকের গল্পের কাদু শেখের বোনরা একুশ শতাকে এসেও মুক্তি পায়নি। যদি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হয় তবে কোনোদিনই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে না। হাসান আজিজুল হকের সমাজভাবনা, চেতনা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা শিল্পকর্মে তিনি বেঁচে থাকবেন আজন্ম।