Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হ‌ুমায়ূন আহমেদের মুনা: বাঙালি নারীর অন্তর্নিহিত জীবন

হ‌ুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় সাহ্যিতিক। যার লেখা জয় করেছে অগণিত পাঠকের হৃদয়। হ‌ুমায়ূন আহমেদ কথার ফেরিওয়ালা। তার কথাসাহিত্য, নাটকের কাহিনি একটি মায়াজাল সৃষ্টি করে। আর সেই রূপকথার জাদুস্পর্শে আবদ্ধ করেন পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের। ঘোরলাগা এক আবেশ সৃষ্টি হয় তার সাহিত্যে। এ কারণেই তার শারীরিক মৃত্যু তাকে পরাজিত করতে পারেনি।

কথাসাহিত্যের অন্যতম জাদুকর হ‌ুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই একটি বিখ্যাত উপন্যাস। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে একটি ধারাবাহিক নাটকও নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত এই নাটকটি কাঁদায়নি এমন মানুষ হয়তো বাংলায় নেই বললেই চলে। সে সময় এই উপন্যাসের আলোকে নির্মিত নাটকের অন্যতম চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যাতে কার্যকর না হয় সেলক্ষে সারাদেশেই মিছিল শুরু হয়। উপন্যাসের চরিত্র থেকে বাকের ভাই এবং মুনা বাস্তব জগতে নেমে আসে। মানুষ হৃদায়ঘনিষ্ঠ, আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ে এই উপন্যাসের কাহিনিতে।

‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র মুনা। যার জন্মই যেন সব দুঃখ-কষ্টের ভার বয়ে বেড়াবার জন্য। জন্ম থেকেই যে প্রতিনিয়ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার। যেসময় একটি মেয়ের খেলার বয়স সেই সময় মুনার কাঁধে পড়ে দায়িত্বের বোঝা। শৈশবেই বাবা-মাকে হারিয়ে আশ্রায় নেয় মামা শওকত সাহেবের বাড়িতে। নিম্ন- মধ্যবিত্ত মামার সংসার। নুন আনতে পানতা ফুরায়। তবু মাথা গোঁজার একটু আশ্রয় পেতে মামার বাড়িতেই থেকেছে। এই উপন্যাসে লেখক মুনার সঙ্গে মামীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখিয়েছেন। যেটি সচারাচর দেখা মেলে না। মুনা বড় হয় কষ্টেশিষ্টে। মামার টানাটানির সংসারে একটু সহোযোগিতার হাত বাড়াতে চাকরিতে ঢোকে।

মামার একটি মেয়ে বকুল। দশম শ্রেণিতে পড়ে। আর ছেলে বাবু সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। মামা শওকত সাহেব কেরানির চাকরি করেন। ওপর মহলের চাপে টাকা হাতিয়ে নেয়ার মামলায় ফেঁসে যান। জেলের হাত থেকে রক্ষা পায় মুনার দায়িত্বশীলতা এবং বাকের ভাইয়ের সাহায্যে। বাকের ভাই দায়িত্বশীল কিন্তু সমাজের চোখে সে ছোটখাট গুণ্ডা। মুনার প্রতি বাকের ভাইয়ের ভালোবাসা আছে। কিন্তু কোনকিছু করেই মুনার মন জয় করতে পারে না বাকের ভাই।

এদিকে মুনা দরিদ্র ঘরের সন্তান হলেও জীবনের প্রতিপদে লড়াই করতে করতে ইস্পাতের মতো ধারালো হয়ে উঠেছে। অন্যায়কে সে প্রশ্রয় দেয় না। খুব শক্ত ধরনের মেয়ে মুনা। মুনা বাকের ভাইয়ের সাহায্য না চাইলেও সে সবার জন্য উদার। বিপদে পড়লেই তাকে সাহায্য করে। এদিকে মুনার সঙ্গে তিন বছরের প্রেম মামুন সাহেবের। কলেজের লেকচারার। তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মামুন কল্যাণপুরে একটি বাসা ভাড়া নেয়। কিছুদিন পরে তারা বিয়ে করে সেখানে থাকবে।

হঠাৎ মামুন বদলে যেতে শুরু করে । মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। কয়েক মাসে কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। তার স্বার্থপরতা এবং অনীহা মুনাকে আবারও কষ্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মামির মৃত্যু, প্রেমিক মামুনের অন্যত্র বিয়ে, মামাতো বোন বকুলের বিয়ে হয়ে নরসিংদী চলে যায়, ভাই বাবুকেও কিছুদিন পর নিয়ে যায়, মামার মৃত্যু, ভদ্রলোকের পাড়ায় পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে কথা বলা এবং সিদ্দিক সাহেবের ভাড়টিয়া উচ্ছেদে বাধা দেওয়ার জন্য বাকের রাজনৈতিক নেতা সিদ্দিক সাহেবের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যা অস্ত্র মামলায় চার মাস জেল খাটে। জেলে থাকবার সময় বাকেরের প্রতি মুনার দুর্বলতা লক্ষনীয়।

প্রতিদিন সে বাকেরের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যায়। মুনা নিজেই উকিল ঠিক করে বাকেরের মামলা লড়ে। পরবর্তীকালে আবার এগারো নাম্বার বাড়ির (যে বাড়িতে তিনজন পতিতা থাকে) কেয়ারটেকার জোবেদ আলিকে খুন করে সিদ্দিক সাহেব। কিন্তু বলির পাঠা হয় বাকের। বাকেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এর মধ্যে দিয়ে কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন লেখক। তবে উপন্যাসের আপাদমস্তক লেখক এক বেদনাময়ী, ভাগ্যহীন, বিড়ম্বিত নারীর চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। যে দুঃসাহসিক হয়েও জীবনের কাছে হার মেনেছে বারংবার।

পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে যেই মামা-মামীর কাছে তার আশ্রায় সেখানেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবনের সুখ বঞ্চিত হয়েছে। আবার যেই মামুনকে ভালোবেসে সুখের নীড় বাঁধার মনোবাসনা পোষণ করেছে সেখানেও মিলেছে আঘাত, প্রতারণা। মুনা যেন হতভাগ্য এক বাঙালি নারীর এক জীবন্ত উদাহরণ।

মুনা শেষপর্যন্ত কোথাও কেউ নেই এর জগতে বাকের ভাইকে আশ্রয় করেই বাঁচার ইচ্ছে পোষণ করেছিল। কিন্তু অত্যাচারীরাই যেন জগতে সবসময় জয়ী হতে থাকে। ফলে বাকের ভাইও হেরে গেলো ষড়যন্ত্রের জাতাঁকলে। মুনা পড়ে রইলো এক আজন্ম হাহাকার বুকে নিয়ে। যার মনে শান্তি, স্বপ্ন, ভালোবাসা কোনটাই দেখা দেয়নি।

বাকের ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মুক্তি ঘটলেও মুনার মধ্যে থেকে যায় অগাধ কষ্ট। মামুন সাহেবের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস থাকলেও সে বিয়ে করে জাহানারা নামের এক নারীকে। মুনাকে ফাঁকি দিয়ে প্রেম এবং পরিণয়ে আবদ্ধ হয়। জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে দুঃখ, গ্লানি, কষ্ট ছেঁয়ে যায় মুনার জীবন। বিশ্বাস ভেঙে গেলেও নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল মুনা। কিন্তু শেষমেশ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে দিয়ে জীবনের সঙ্গে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস। কোথাও কেউ নেই।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ বাঙালি পাঠকের হৃদয়কে আলোড়িত করেছেন বাকের এবং মুনা চরিত্র নির্মাণের মাধ্যমে। বাঙালির ইতিহাস যতদিন লিখিত থাকবে তাঁর অনবদ্য চরিত্র মুনা ততদিন নারীর জীবনের অন্তনির্হিত গ্লানি, বেদনা, হাহাকার সর্বোপরি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটাবে। আজ এই মহান কারিগরের জন্মদিন। অন্তরের শতকোটি প্রণাম রইলো।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ