Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর উন্নয়নে যত বড় বাধা

আজও সমাজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান নিশ্চিত করা যায়নি। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। নারীর সঙ্গে আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রূঢ় আচরণেই অভ্যস্ত! আর এই অসম্মান-অশ্রদ্ধার ফলে সর্বত্র নারীরা নানারকম নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। তবে অধিকাংশই সম্মানহানির লজ্জায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না। নারীর উন্নয়নের পথে যৌনহয়রানি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। এ ব্যাপারে অনন্যা কথা বলেছে কয়েকজন নারীর সঙ্গে।

সরকারি কর্মকর্তা দীপ্তি মণ্ডল দিতি বলেন, ‘‘নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার /কেহ নাহি দেবে অধিকার…হে বিধাতা।’ রবীন্দ্রনাথের নারী শুধু রক্ত মাংসের নারী নয়, এ নারী যেন ডানা মেলে জীবনের উচ্ছ্বল স্বাধীনতায়, কর্মে, জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, প্রতিবাদে। কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার এবং সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে জাতিকে একটা সমৃদ্ধ সংবিধান উপহার দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংবিধানের ১৯(১) সুযোগের সমতা
১৯ (৩) সর্বস্তরের মহিলাদের অংশ গ্রহণ। ২৮ (২) সমান অধিকার। ১৭(ক) সর্বজনীন শিক্ষা (বালক-বালিকা) গ্রহণ। এই ঘুণে ধরা সমাজে নারী এক বিশেষ জাতি যাদের সাংবিধানিক সম্মান দিয়েও জাতির কাছে লাঞ্ছিত হতে হয়। আমি মনে করি, নারীকে মর্যাদা এবং সম্মান দিলে যৌনহয়রানি এবং সহিংসতা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে।’’

দীপ্তি মণ্ডল আরও বলেন, ‘সমাজে, রাষ্ট্রে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে এমনকি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী সম্মান বিষয়ক আলোচনা চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। নারী অধিকার ও সম্মান বিষয়ক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয়ও হতে পারে অথবা শ্রেণি শিক্ষার কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
একজন নারী যদি ৫০ টাকা উপার্জন করে সংসারে দেয়, তবে তার সংসারে, সমাজে সম্মান ও গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণে। তার সিদ্ধান্তের মূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেই নারীর উপার্জন যদি শুধু যৌনহয়রানি নামক বিষফোঁড়ায় নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার চেয়ে অসহায় প্রাণী আর পৃথিবীতে একটিও নেই।’

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পরিবারে স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে কাজ ভাগাভাগি করে নেয় অথবা একটু সময় দেয়, তাহলে ওই নারীর পারিবারিক সম্মান ও কঠিন জীবন থেকে বের হওয়ার রাস্তা তৈরি হয়। এজন্য সমাজে পুরুষ শ্রণিকে সচেতন হওয়া দরকার। তার পরিবারের নারী সদস্যের প্রতি এতে পুরুষে আত্মমর্যাদা কমে না। বরং নারী সমাজে সমাদৃত হোন।’

এই সরকারি কর্মকতা আরও বলেন, ‘নারীকেও তার আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে। অতিরিক্ত মুখাপেক্ষী মানুষ কখনোই সমাজে সম্মানের জায়গা করতে পারে না এটাই রীতি। আমি একটা বিষয় দেখেছি, ছোট বেলা থেকে, তা হলো জনসমাগম ও ভিড়ের মধ্যে যৌন-হয়রানির জন্য দুবৃর্ত্তরা উপযুক্ত সময় বেছে নেয়। বিচারহীনতার এই দেশে খুন আর ধর্ষণের মামলা যেখানে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে সেখানে যৌন-হয়রানির দায় কে নেবে? এজন্য মেয়েরা জনসমাগম সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি হয় না। অধিক লোকে ভয় পায়, সংকোচন বোধ করে। বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে গৃহ কাজে মগ্ন হয়। অনেক বড় বড় স্বপ্নের মৃত্যু হয়ে যায় যৌনহয়রানির বিষফোঁড়ার কাছে।’

এই কর্মকতা বলেন, ‘বিশ্বে ৭৩৬ মিলিয়ন নারীর মধ্যে প্রতি তিন জনের একজন যৌন হয়রানির শিকার হয় এটা যেন সমাজ থেকে বৈশ্বিয়িক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর কোন কিছু নারীর জন্য প্রস্তুতি নেয়নি আদিকাল থেকে। হিংস্র পুরুষ শাসিত সমাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য নারীকে কৌশলী হতে হয়েছে। জীবনে দূর্ঘটনার ঘটতেই পারে তার জন্য আত্মাবিশ্বাসী হতে হবে। এবং শুন্য থেকে শুরু করতে হবে যাত্রা টা তাহলে সফল হওয়া সম্ভব।’

লেখক প্রিয়তু শ্যামা বলেন, ‘নারীর উন্নয়নের পথে যৌন হয়রানি অনেক বড় একটি বাধা। সে যখন একটি কন্যাশিশু নারী হয়ে ওঠেনি, তখন থেকেই এর সূত্রপাত ঘটে যায়। শিশুটির স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া হয় জীবন শুরুর প্রারম্ভেই। তা করে খুব দূরের কেউ নয়, একেবারে নিকট জনেরাই। শিশুটি গুড টাচ, ব্যাড টাচ বুঝতে পারে, তখন থেকেই তার আপন বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ দ্বারা। শিশুটির জীবনে আসে প্রবল এক ধাক্কা। কোনো শিশু এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতেই পারে না, আবার কেউ-বা পারে। না-পারা শিশুটি হারিয়ে যায় তার সম্মানহানির গ্লানি নিয়েই। আর যে কন্যাশিশুটি সামনে এগিয়ে আসতে উদ্যোগী হয়, সে-ও পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে স্কুলের শিক্ষক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মক্ষেত্রে বসশ্রেণির কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে যৌন-হয়রানির শিকার হয়। একসময় মেয়েটি নিজেকে সম্মান করতেই ভুলে যায়। মেয়েটির স্বপ্ন বাধাপ্রাপ্ত হয় পুরুষশ্রেণির কুপ্রবৃত্তির কাছে। মেয়েটি হেরে গিয়ে হারিয়ে যায় নিজের মধ্যে। তার সম্মান ধুলোয় লুটোপুটি খেলে। ফলে অনেকসময় কন্যাশিশুটি, পরিণত নারীটি আত্মহত্যার পথকেই বেছে নেয় সম্মান বাঁচানোর হাতিয়ার হিসেবে। আর এসব হচ্ছেই একমাত্র আইনের সুশাসনের অভাবে, জবাবদিহিতার অভাবে।’

এই লেখক আরও বলেন, ‘সমাজে যখন কোনো অন্যায়কে টাকার নিচে, ক্ষমতার কাছে চাপা দেয়া হয়, তখন এসব যৌন হয়রানি বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের উচিত শিশুদের চোখে চোখে রাখা। কোনো আত্মীয় পরিজনদের কাছে কন্যাশিশুটিকে একা না-ছাড়া। ছোটোবেলা থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ঘরে কন্যাশিশুকে কিভাবে মাথা উঁচিয়ে, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মানের মাধ্যমে এগুতে হবে তার শিক্ষা দেওয়া। নারীর কর্মক্ষেত্রে কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো নারীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করলে তার বিচার জনসম্মুখেই হতে হবে। আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। মোদ্দা কথা নারীটি যেন মুখ বুজে লুকিয়ে না-রাখে নিজেকে, অপরাধীকে যেন আড়াল না-করে, তার সুব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীর একটা আলাদা নিজস্ব সত্তা আছে। নারী কোনো ভোগ্যপণ্য নয়।’

সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ইসরাত জাহান দিপা বলেন, ‘নারীর উন্নয়ন ও সম্মানের পথে যৌনহয়রানি বড় বাধা। কোনো নারীর অনুমতি বা সম্মতি ব্যতীত তার সঙ্গে যেকোনো যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলা কিংবা চেষ্টা করা অথবা অশালীন ব্যবহার করাকেই যৌন নির্যাতন বলে। এই নির্যাতন শুধু শারীরিকই না বরং মানসিক বা আর্থিক ভাবেও হতে পারে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ উইমেন্স ল’ইয়ার অ্যাসোসিয়েশনের একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য
আদালতের দিক নির্দেশনা অনুসারে যেসব বিষয় যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে।’

ইসরাত জাহান দিপা বলেন, ‘সভ্যতার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমরা আলোর দেখা না পেয়ে কেবল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী লজ্জা, মান-সম্মান হারানোর ভয়ে যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেন না। এমনকি তিনি যে ভুক্তভোগী তাও স্বীকার করেন না। ঘরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থলে দিন দিন বাড়ছে নারীর উপস্থিতি। উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সঙ্গে নারীরা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি নারীদের নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ভয়াবহ হারে বেড়ে যাচ্ছে। যখন এই হয়রানির শেষ সীমা অতিক্রম করে, তখনই তা প্রকাশ পায়। অনেক সময় হত্যার হুমকি ও ভয় দেখিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়।এই হয়রানি নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ এই বিষয় দুটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। অধিকাংশক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারই দায়ী হয়ে থাকে।’

এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রায় ৮২ শতাংশ নারী এ দেশে জনসমাগমপূর্ণ স্থানে হয়রানির শিকার হন। গত জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৩৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই গণপরিবহন ব্যবহার করে এবং শতকরা ৯৪ শতাংশ নারী যাত্রী কোনো না কোনোভাবে গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন। এই বছরের জুলাইয়ে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৩৯০ জন নারীর একটি তালিকা তৈরি করে তথ্য সংগ্রহকারী দলের মাধ্যমে একটি জরিপে দেখা যায়। যৌন হয়রানি শিকার হয়েছেন এমন ১৩৫ জন কর্মজীবী নারী।অনেক সময় চাকরিচ্যুত করার হুমকি কিংবা প্রমোশন প্রলভনের ফাঁদে ফেলে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। এমনকি পুলিশ নারী কর্মীও এই হয়রানির আওতামুক্ত নয়। ২০২২ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌন হয়রানির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪, আপত্তিকর মেসেজ ৬ দশমিক ৯৩ ও সাইবার বুলিং ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ।’

ইসরাত জাহান বলেন, ‘যৌন হয়রানির কারণ হিসেবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব, নারীকে পণ্য ও ভোগের বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা, পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রবাহ, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার, মাদকাসক্তি এবং সুশিক্ষার অভাব, নারীদের অধিকার সম্বন্ধে অসচেতনতা। মূলত নারীর সচেতনতা এই অপরাধ রোধে সহায়ক। আইনের আশ্রয় গ্রহনে সচেষ্ট হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন কর্মজীবী নারীকে তার প্রতিষ্ঠানের নীতি সম্পর্কে জানতে হবে। যৌন হয়রানি সংক্রান্ত অভিযোগ এলে সেগুলো কোথায় এবং কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে, সে বিষয়টি প্রত্যেকটি নারীকর্মীকে তার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। গণ পরিবহনে, জনসমাগমপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা নিশ্চিত করতে হবে।’

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ