Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থার সময়োপযোগী উদ্যোগ

খুব বেশিদিন আগের ঘটনা না। ঢাকা থেকে এক তরুণী আন্তঃনগর ট্রেনে উত্তরবঙ্গ ফিরছিলেন। জয়দেবপুর স্টেশন অতিক্রম করার সময় হঠাৎ-ই তরুণীর পিরিয়ড শুরু হয়। চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে তরুণী অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করেন। কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় তাকে বিপদে পড়তে হয়। পিরিয়ড শুরু হলে একটি মেয়ের জন্য এমনিতেই নানা অস্বস্তি কাজ করে। আর ভ্রমণকালে এমন কিছু হলে কতটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হতে পারে তা অনেক মেয়েই জানেন। যাহোক, এমন ঘটনায় তরুণীর মনে একই সঙ্গে ভয় ও লজ্জা কাজ করছিল। আমাদের সমাজে এখনও পিরিয়ডকে অপবিত্র সময় ভাবা হয়। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে এমন ভাবনা সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তাই তরুণীর লজ্জা পাওয়াটা স্বাভাবিক। পরিস্থিতি তার জন্য এতটাই ভয়াবহ ছিল যে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন।

তরুণীর সঙ্গে থাকা একজন সহযাত্রী বিষয়টি বুঝতে পারেন। তিনি দ্বিধা না করে ওই তরুণীর সঙ্গে কথা বলেন। এবার তিনি রেলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের খোঁজ শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা জানালেন পুরো ট্রেনে এমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। তাকে রেলকর্মীরা আশ্বস্ত করলেন পরের স্টেশনে নেমে তিনি ফার্মেসি থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে নিতে পারবেন। এজন্য যত সময় লাগে লাগুক। রেল অপেক্ষা করবে। ওই ব্যক্তিটির নাম মোরশেদুল হক। তিনি রংপুরের বদগঞ্জের একজন উন্নয়নকর্মী। সরকারি যান-ব্যবস্থায় এমন কোনো সুবিধা না থাকায় মোরশেদুল যথেষ্ট বিব্রত হন।

সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় মোরশেদুল জানান, রেলের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করেও তিনি সাড়া পাননি। তাই নিজ উদ্যোগে তিনি পার্বতীপুর রেলজংশন ছেড়ে যাওয়া তিনটি আন্তঃনগর ট্রেনে ৪০টি করে বেল্টযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করেছেন। এই কাজে মোরশেদুল হককে আব্দুল আউয়াল রানা নামের একজন ট্রেনচালক সহযোগীতা করেন। মোরশেদুল হকের এই কার্যক্রমে রেলকর্মীরাও ব্যাপক সাড়া দিয়েছে।

মোরশেদুল হকের উদ্যোগটি ক্ষুদ্র পরিসরে হয়েছে একথা সত্য। বিশেষত একজন যুবকের এমন উদ্যোগ অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু এমন কিছুতে আদৌ বিস্মিত হওয়ার কিছু আছে? গণপরিবহনে ফার্স্ট এইড বক্স থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। যাত্রাপথে কেউ অসুস্থ হলে যেন সহজেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে পারেন সেজন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত রেলের জন্য ফার্স্ট এইড বক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায় এসব ফার্স্ট এইড বক্স লোকদেখানো ব্যাপার হয়ে আছে। অধিকাংশ সময় ভেতরে কিছুই থাকে না। এ নিয়ে বহুবার আলোচনা হলেও প্রতিকার মিলেনি। যদিও আস্তে আস্তে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তঃনগর রেলে নারী কামরা সংযুক্তির ঘটনা প্রশংসিত হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত সব রুটের রেলে নারী কামরা সংযুক্ত করা হবে। এসব প্রত্যাশার পাশাপাশি সঙ্গত কারণেই যাত্রীর সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি নিয়েও আমাদের প্রত্যাশা বেড়ে যায়।

দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য রেলপথই সবচেয়ে ভালো উপায়। কিন্তু রেলে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগের কথাও নতুন কিছু নয়।যাত্রাপথ যত ক্ষুদ্রই হোক, নারী যাত্রীদের জন্য নানা সমস্যা ওৎ পেতে থাকবেই। তারমধ্যে হঠাৎ পিরিয়ড শুরু হওয়া সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিব্রতকর। কারণ পিরিয়ড শুরু হলেই একজন নারী তা বলতে পারেন না। ওই প্রাথমিক মুহূর্তে থাকে ঋতুস্রাব নিঃসরণের দ্রুত পথ খুঁজতে হয়। কিন্তু চলার পথে এমন কিছু করা সহজ কিছু নয়। রেলের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অনেক সময়ই ভালো নয়। তাই ওই নারীকে বিব্রত হওয়ার পাশাপাশি প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণাও পোহাতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ফার্স্ট এইড বক্সে স্যানিটারি প্যাড থাকা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি আপাতত খুব ক্ষুদ্র একটি সমস্যা বলে মনে হলেও এর গুরুত্ব বোঝা কঠিন কিছু নয়। শুধু একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় রেলে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশের যাত্রাপথের অবকাঠামো থেকেই শুরু করা যাক। সচরাচর দূরপাল্লার বাসযাত্রাগুলোর ক্ষেত্রে অনেক সময় থামার অবকাশ থাকলেও রেলে তা সম্ভব নয়। মোরশেদুল হকের ক্ষেত্রে রেলকর্মীরা যথেষ্ট সাহায্য করলেও সব রেলে এমন সাহায্য পাওয়ার আশা করা যাচ্ছে না। যদি সাহায্য পাওয়া যায়ও, তবু রেল স্টেশনে নেমে ফার্মেসি খুঁজে স্যানিটারি প্যাড কেনার সম্ভাবনা মাথায় রেখে দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। একজন নারীর পিরিয়ড রাতেও হতে পারে। তখন কি স্টেশনে নেমে ফার্মেসি খোঁজার বিষয়টি মাথায় রাখা সম্ভব? আমাদের এই ঘটনার তরুণীকে সাহায্য করার জন্য মোরশেদুল এগিয়ে এসেছেন যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই এমন সাহায্য পাওয়া যাবে কি? আর রাতে একজন তরুণী পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে কতটা নিরাপদ থেকে ফার্মেসির অনুসন্ধান করবে?

অর্থাৎ আমাদের এই সম্ভাবনার ভাবনাকে দ্রুত মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। সময় এবং সম্ভাবনার বিষয়টি আমলে রেখে আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রতিদিন রেলে প্রচুর নারী যাত্রী যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, কর্মী এবং ভ্রমণকাঙ্ক্ষিত অনেকেই থাকেন। যেকোনো সময় তাদের পিরিয়ড শুরু হতে পারে। সবসময় সবাই প্রস্তুতি রাখেন বা বলেই আমরা এমন পরিস্থিতিকে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে ধরে নিয়েছি। আর এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যদি রেলে নারীর স্যানিটারি প্যাডের ব্যবস্থা করা হয়, তাকে অন্তত লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতে হবে না। বরং নির্ধারিত জায়গাতেই তিনি প্যাড নিতে পারবেন। ইতোমধ্যে বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণের নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে বিভিন্ন স্থানে এর প্রয়োগ করতে হবে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও গ্রামীণ অঞ্চলের পাশাপাশি রেলেও এমন সেবা চালু করা জরুরি। নারীর বিচরণের জায়গা সহজ করা না গেলে গণপরিবহন নারীর জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এমনিতেই নারী নিরাপত্তা নিয়ে নানা আশঙ্কা রয়েই গেছে। তবে যেমনটা বলেছি, মোরশেদুলের ছোট উদ্যোগ অন্তত বড় উদ্যোগের পথ সহজ করেছে। এই উদ্যোগকে প্রাণবন্ত রাখতে হবে। সরকারকে দ্রুত বিষয়টি আমলে নিয়ে এমন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রেলে নারী কামরা যেহেতু চালু করা গিয়েছে সেখানে এমন সুবিধা এখনই চালু করা যেতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা, এমন সহজ সুবিধা রেলে চালু করা গেলে নারী যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমে আসবে।

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ