দীনেশচন্দ্র সেনের ‘মহুয়া’: বিরহময় জীবনকাব্য
দীনেশচন্দ্র সেন (৩ নভেম্বর ১৮৬৬-২০ নভেম্বর ১৯৩৯) বাংলা লোকসংস্কৃতির জগতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তিনি পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। আর সেসব উপকরণের সাহায্যে লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নির্ভর গ্রন্থ ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’। এই লোক-সাহিত্য বিশারদের আরেক সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি লিটারেচার’।
গ্রামবাংলার পুঁথি সংগ্রহ করে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা লোকসাহিত্যের ধারাকে বিশ্ব দরবারে স্থান করে দিয়েছেন। জীবনব্যাপী বাংলা সাহিত্যের সাধনায় অসমান্য ভূমিকা পালন করে চির অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকা পরবর্তীকালে প্রায় ২৩ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে এই গ্রন্থটি এক অভাবনীয় আসন গ্রহণ করেছে।
‘মহুয়া’ দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত গ্রাম্য পুঁথির সংগ্রহিত রূপ। কাব্যটিতে একটি অনবদ্য প্রেম কাহিনি স্থান পেয়েছে। মহুয়া জনমদুঃখী। মাত্র ছয় বছর বয়সে রাতের অন্ধকারে কাষ্ণনপুর গ্রামের এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ঘর থেকে তাকে চুরি করে হুমরা বেদে। অপরূপ সুন্দরী মহুয়া, হুমরা বেদের আশ্রয়ে বড় হয়। মেয়ের মতো স্নেহ-মমতায় লালিত-পালিত মহুয়া বেদেদের সহোযোগী। বেদে জীবন ভাসমান। তারা এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে ভেসে চলে। দুই-তিন দিনের সফর শেষে তারা এসে উপস্থিত হয় বামানকান্দা গ্রামে। এই গ্রামের জমিদারের সভায় নাচ-গানে তাদের মুগ্ধ করে বেদের দল। জমিদার নদের চাঁদ মহুয়ার রূপের ঝলকে প্রেমে পড়ে যায়। বামানকান্দা গ্রামেই বেদে দলের জন্য বসতি গড়ার জমি দেয় নদের চাঁদ। মহুয়ার মনেও নদের চাঁদের প্রতি অনুরাগ জন্মে। নদের চাঁদের সঙ্গে মহুয়ার দেখা হয় জলের ঘাটে। সন্ধ্যাকালে নদীর ঘাটে একলা যায় মহুয়া।
বাঙালি নারীর লজুক স্বভাব মহুয়া চরিত্রেও বিদ্যমান। মনের গহীনে অনুরাগ লুকিয়ে থাকলেও মুখে স্বীকার করতে নারাজ। নদের চাঁদ একলা ঘাটে মহুয়ার সঙ্গে আলাপ জমাতে চায়। কিন্তু মহুয়া পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে নারাজ। তাইতো মহুয়ার কণ্ঠে শোনা যায় বাঙালি নারীর লজ্জাময় উক্তি-
তুমি ত ভিন দেশী পুরুষ আমি ভিন্ন নারী।
তোমার সঙ্গে কইতে কথা আমি লজ্জায় মরি।
লজ্জা নারীর ভূষণ। আর মহুয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালি নারীর জীবনের সলজ্জ রূপে মহুয়ার প্রেমে পড়ে নদের চাঁদ। তাই মহুয়ার লজ্জাকে উপেক্ষা করেই তার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করে। দুজনের অবদমিত প্রেমের প্রকাশ ঘটে এক অপরিমেয় কাব্যের ছোঁয়ায়। বাঙালি নারীর স্বরূপ ফুটে উঠেছে মহুয়ার চরিত্রে। নদীর ঘাটে নদের চাঁদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেলেও তার মনের খবর নিতে পিছপা হয়নি মহুয়া। ছল করে নদের চাঁদের সুন্দরী নারী নিয়ে ঘর করার কথা বলে। কিন্তু নদের চাঁদ মহুয়ার মতো সুন্দরী পেলে তবেই বিয়ে করবে। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করতেই বলে ওঠে-
লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর
গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুব্যা মর।
কোথায় পাব কলসী কন্যা কোথায় পাব দড়ী
তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি।
শৃঙ্গার রসের রসিক নদের চাঁদের প্রণয়ে মুগ্ধতা ছড়ায় মহুয়ার মনে। নদের চাঁদের দেখা না পেয়ে মহুয়া চঞ্চল। প্রণয়ীর বিরহে মহুয়ার দিবানিশি অন্তর পোড়ে। নদের চাঁদ তার প্রাণের স্বামী। মহুয়ার সখী পালঙ্ক। মহুয়ার দুঃখে দুঃখী। পালঙ্ক বুদ্ধিমতী। সে জানে মহুয়ার এই প্রেম বেদে সমাজ এমনকি জমিদার সমাজও মেনে নেবে না। হুমরা বেদে মহুয়াকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করে। নদের চাঁদও মহুয়ার শোকে মুষড়ে পড়ে। একদিন গ্রাম ছেড়ে বলেন বেরিয়ে পড়ে মহুয়ার খোঁজে। মহুয়া এবং নদের চাঁদের অনবদ্য প্রেম বিষাদে রূপ নিয়েছে। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও হুমরা বেদের ষড়যন্ত্রে মহুয়া প্রেম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু জাতিকূল ছেড়ে নদের চাঁদ মহুয়াকে খুঁজে বের করে। এক গভীর রাতে তারা দেশান্তরি হয়-
বাপের আছে তাজি ঘোড়া ঐ না নদীর পারে
দুইজনেতে উঠ্যা চল যাইগো দেশান্তরে।
না জানিব বাপ মায় না জানিবে কেহ।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী কইরা ছাইড়া যাইবাম দেশ।
দেশান্তরি হয়েও মহুয়া এবং নদের চাঁদের হুমরা বেদের হাত থেকে রক্ষা মেলেনি। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে বনের মধ্যে উপস্থিত হয় বেদের সর্দার হুমরা ও তার দল। মহুয়াকে বিষলক্ষের ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বলে। কিন্তু পতিপরায়ণা মহুয়া স্বামীর ভালোবাসাকে রক্ষা করতেই আত্মঘাতী হয়।
শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে
জন্মের মতন বিদায় দেও এই মহুয়ারে।
শুন শুন পালং সই শুন বলি কথা
কিঞ্চিৎ বুঝিবে তুমি আমার মনের বেথা।
মহুয়া জনমদুঃখী নারী। হুমরা তাকে চুরি করে বেদের জীবন দিয়েছে। যেই জীবন ভাসমান। মহুয়ার জীবনে সুখের জায়গা নদের চাঁদের ভালোবাসা। কিন্তু সেখানে হুমরা বেদের ষড়যন্ত্রে লণ্ডভণ্ড হয় প্রেম, দাম্পত্য, জীবন। মহুয়ার প্রতিবাদী ভাষা নিজেকে শেষ করে। কিন্তু হুমরা বেদেকে প্রতিহত করার চেষ্টা সে করেনি। সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও জীবন রক্ষা পায়নি।
নদের চাঁদ জমিদার। মহুয়ার ভালোবাসাকে গ্রহণ করে সমাজ বিচ্যুত হয়েছে। মায়ের ভালোবাসা উপেক্ষা করে প্রিয়তমার খোঁজে বেরিয়েছে। তাকে নিয়ে দেশান্তরি হয়েছে। কিন্তু নদের চাঁদ এবং মহুয়া হুমরা বেদের আক্রোশের কাছে পরাজিত হলো! এই পরাজয় নাটকীয়। মহুয়া বুদ্ধিমতী। পালং সইয়ের পূর্ব সতর্কতা সুর শুনে সে বুঝতে পারে। তবে ভালোবাসাকে আগলে না রেখে জীবনের পরাজয় মেনে নিলো কেন?
দীনেশচন্দ্র সেন গ্রামবাংলার জনপ্রিয় কাহিনিগুলো সংগ্রহ করে তুলে ধরেছেন তার ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ গ্রন্থের আলোকে। ‘মহুয়া’ এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম একটি লোককাহিনীকাব্য। যা নির্মাণে আজও তিনি বাংলা লোকসাহিত্য জগতে অম্লান হয়ে আছেন।