টক্সিক রিলেশনশিপে সন্তান কেন হাতিয়ার
যান্ত্রিক জীবনে দিনদিন মানুষের মাঝে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। জীবনের প্রতিটি সমস্যা গিয়ে একজায়গায় জমা হয়। সেটি পরিবার। দুজন মানুষের ভালোলাগা-মন্দলাগা, চাহিদা, প্রাপ্তির জায়গা ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু বর্তমান সমাজে কেউই যেন এই ভিন্ন মানসিকতা মানতে নারাজ। স্ত্রীর চাহিদা স্বামী কেন তার না বলা কথাগুলোও চোখের ইশারায় সবটা বুঝে নেন না! আবার স্বামীর ইচ্ছেও ঠিক তেমনই। কেনই বা তার মনের মতো নয় বউটি! ফলে দুজনের এই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খাতায় জমা হতে থাকে একটু ধুলো। যেই ধুলো একটি সময় এতটাই বেশি হয়ে যায় যে কোথায় সম্পর্ক আর কোথায় তারা দুজন তার তলও খুঁজে পান না! তখনই শুরু হতে থাকে মানসিক ও শারীরিক দুরত্ব।
এর মাঝে সৃষ্টি হয় কোনো একপক্ষের দিক থেকে নতুনভাবে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর উদ্যোগ। যতই হোক জোড়াতালি তবু যেন পরিবার-পরিজন-সমাজের কাছে মুখ রক্ষা হয়। বাবা-মায়ের মানসম্মান যেন ক্ষুণ্ন না হয়। ফলে চলতে থাকে অভিনয়। শুরু হয় মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার তকমা! যেখানে মানসিক শান্তির ন্যূনতম সাক্ষাৎ না ঘটলেও পৃথিবীর বুকে নিজেদের ভালো সম্পর্কের জাহির করতেই হবে। এই টানাপড়েনে সন্তানকেই হাতিয়ার করে অধিকাংশ দম্পতি! কিন্তু টক্সিক রিলেশনশিপে সন্তান কেন হাতিয়ার?
সেই লক্ষ্যে চলার নির্দেশ পরিবারের অভিভাবকরাই দিয়ে থাকেন বেশি। সম্পর্কের অবনতি কেউই চান না। ফলে সবাই প্রথমত ও শেষতক মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী হন। সে অনুযায়ীই অনুজদের পরামর্শ দান করেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের জীবনের নানা ঘটনা বা অভিজ্ঞতা দিয়ে এই দম্পতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সময় বদলেছে। জীবনযাপন পদ্ধতি বদলেছে। সেইসঙ্গে সবাই যে একই পদ্ধতি বা একই মানসিক স্থিরতার হবে না, সেটাও অনেকেই মানেন না। আর এই অভিজ্ঞতার জেরে সবার পরামর্শ মূলত এমন,
প্রথমত, সন্তান না থাকলে সন্তান নেওয়ার পরামর্শ
দ্বিতীয়ত, সন্তান থাকলে তার ভবিষ্যৎ ভাবনা
টক্সিক রিলেশনশিপে এই দুই পরামর্শ ব্যক্তির জীবনকে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে রাখে? আমাদের সমাজে অগ্রজদের প্রধান এবং একমাত্র ধারণা দাম্পত্য জীবনের টানাপড়েন, নানাবিধ সমস্যা দূর করার একমাত্র হাতিয়ার সন্তান। ফলে তারা এই পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী প্রজন্মকে পরিচালনা করেন। এই ফাঁদে অধিকাংশ নর-নারী পা দেয়। কেউ খানিক বুঝেই দেয়, কেউ একটু চেষ্টা করতেই মূলত বড়দের প্রেষণায় অনুপ্রাণিত হন। ফলে দীর্ঘমেয়াদি গড়ে ওঠা সমস্যা যে কমতে থাকে, এমন নয় বরং কিছুদিন স্তিমিত থাকে। আবার কখনও তা অতিমাত্রায় বাড়তেও পারে। এক্ষেত্রে বলির পাঁঠা দুজনই। নিত্য দাম্পত্য কলহের মধ্যেও দিব্বি সংসার নামক বেড়ি গলায় পরে জীবন নির্বাহ করতে থাকেন। যার কারণে আমাদের সমাজে দাম্পত্য কলহের জেরে নির্যাতন, হত্যা বেড়েছে।
দাম্পত্য কলহের জেরে যেই হত্যা, আত্মহত্যা বা নির্যাতন হয় এটার একটু পেছনে গেলে দেখা যায়, হত্যা বা আত্মহত্যা হয়েছে সেটা কোনো নতুন কারণ নয়। বরং দীর্ঘদিনের দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতির কারণেই তা ঘটেছে। পাড়া-প্রতিবেশী- আত্মীয়-স্বজনও স্বীকার করেন যে, তাদের দাম্পত্য কলহ ছিল। তবে কেন জোর-জবরদস্তি করে তাদের এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে ঠেলে দেওয়া?
প্রথমত সন্তান না থাকলে সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে এই দম্পতিকে একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে ফেলা। দ্বিতীয়ত সন্তান থাকলে তার ভবিষ্যৎ ভাবনায় এক ছাদের নিচে দীর্ঘদিন থাকার মিথ্যা অভিনয়। কিন্তু এর ফলে স্বাভাবিকভাবে কে বা কারা উপকৃত হয়? সমাজ?
টক্সিক রিলেশনশিপে থেকেও যেই সন্তানের মঙ্গলের জন্য, পরিবার-পরিজনদের কাছে, সমাজের মাঝে সম্মান বাঁচানোর জন্য এত তাগিদ সেখানে যখন কারো অপমৃত্যু ঘটছে! তখন এই সম্পর্কের কী মানে? এমনকি সন্তানই কি বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে?
মূলত টক্সিক রিলেশনশিপে থাকার অন্যতম হাতিয়ার সন্তান হলেও লাভবান সন্তান নয়! বরং তাদের মানসিক বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায় তা। তাহলে কিসের জেরে বাঁধছে পরিবারগুলো? সমাজই একমাত্র কারণ। যার বলি হচ্ছে নিরীহ কিছু মানুষ।
তাই যেখানে সুখ- শান্তি বা আত্মিক মুক্তি না ঘটে সেখানে সন্তানের দোহাই দিয়ে অভিনয়ের জীবন পালন না করাই উচিত। জীবনে অপমৃত্যু বা আত্মহত্যার শিকার না হয়ে স্বচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এ লক্ষে নারীর প্রয়োজন স্বাবলম্বী হওয়া। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস স্থাপন করা। কারো হাতের পুতুল নয় বরং নিজের ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে জীবন পালনের ব্রত গ্রহণ করতে হবে।