Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: মানুষের মানচিত্রে নারী

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬- ২১ জুন ১৯৯১) বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্য কবি। যার কবিতায় একাধারে স্থান পেয়েছে প্রেম, দ্রোহ, মানুষের হৃদয়ের যাতনা, শোষণ, ধর্মান্ধতা, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি। তাঁর তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বরে বাংলার আকাশে ঘনায়িত মেঘ যেন তার আপন অস্তিত্ব খুঁজে ফেরে। এক পশলা বৃষ্টি শেষে যেমন প্রকৃতিতে শান্তি নেমে আসে তাঁর কবিতা, গানেও মনের মাঝে স্বস্তি ফেরে। কখনো কখনো শোষণের তীব্রতা অনুভব করে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে ওঠে মনে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর পরিচয় গান, নাটক, ছোটগল্প রচিয়তা হলে তিনি একজন ক্ষুরধার কবি৷ যার কবিতায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে প্রেম। আর প্রেমের অনুষঙ্গে এসেছে নারী। এই নারীকে তিনি রূপ দিয়েছেন কমোলতায়। স্বল্পায়ু জীবনে তিনি ৭ টি কাব্যগ্রন্থ, গল্প, কাব্যনাট্য ও অর্ধশতাধিক গান রচনা করেছেন।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ‘মানুষের মানচিত্র’ কাব্যগ্রন্থের আদ্যোপান্ত নারীর প্রেমেই নিজেকে মশগুল রেখেছেন। প্রেমিকাকে আহ্বান করেছেন ‘সোহাগি লো’ বলে। যার মধ্যে দিয়ে তার মনের গহীনে নিমিষেই প্রবেশ করা যায়। ভালোবাসার ফুলদানিতে অবিরাম মধুর গন্ধে তাঁর হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তুলছে। প্রাণের মাঝে বাউরি বাতাস জাগে। কবির হৃদয়ে দুরত্ব শেল বিঁধেছে সবসময়। কিন্তু প্রেয়সীর মনে কি তাঁর জন্য কোনো মায়ার দেখা মিলেছে? কবির কবিতায় এ এক অন্যবদ্য প্রেমের মুহূর্ত। তাকে কাছে পাওয়ার আকুল বাসনা। কবি বলেছেন,

এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদল।
কবে পাবো? কবে পাবো আল্ হীন একখণ্ড মানব-জমিন?
পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।
মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বণের তিথি
কবে পাবো? কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন?

রাত কাটলেও দেহের আগুন নেভে না। পরান নেভে না। কবি প্রেমে মত্ত। যে প্রেমের ছাইচাপা আগুনে বারবার তাকে দগ্ধ হতে হয়। প্রেয়সীর ডাক বুঝলেও যেন সাড়া দেওয়ার কিছুই নেই। বুড়ো ভাতারের ঘর সংসারে সারাদিন সন্তানের যত্ন নিয়েই ব্যস্ত প্রেমিকা। প্রেমের ফুল দলে মিষে যায় তাই তো। মাঝ রাতে পাখির গলায় যতই প্রেমিকের ডাক আসুক ঘর ছেড়ে বের হতে সে পারে না। কিন্তু যদি ভোর বেলায় আসে তার ডাক, রৌদ্রের তাতানো দুপুরে শেকলের শিক ছিঁড়ে ধরা দেবে তার প্রেমিকা। কবি যেন সব বুঝেও নিশ্চুপ। তাইতো কবির কাছে নিবেদন,

রাত্তির কাটে না আর। দেহের আগুন নেভে, পরান নেভে না। কোনদিন শখ হলে কাটা ঘায়ে ফের তিনি ছিটান লবণ, দিনভর দেহ জ্বলে, সারারাত জ্বলে এই নওল যৈবন। পোড়ার জীবন নেবে, পোড়া-কপালিরে তবু মরন নেবে না…

পাখির নাহান কেন ডাক দাও নিশিরাতে? বিহান বেলায় যদি পারো ডাক দিও, ডাক দিও রোদ্দুরের তাতানো দুপুরে, কেমন ছিঁড়তে পারি শিকলের শিক দেখো জীবন-নূপুরে গান তুলে কেমন আসতে পারি স্বপ্ন-ধোয়া হৃদয় তলায়।

প্রেমের নিবেদন যেন রূপ পেয়েছে নানামাত্রায়। জীবন তরী ভাসিয়ে দিয়ে দিন গুনেছে প্রেমিকের। মাঝি বউ দিন গোনে কিন্তু স্বামীর দেখা নেই। তাদের প্রেমের অনবদ্য রূপে ঘুরেফিরে এসেছে দুঃখ-দারিদ্র্য। একা ঘরে দেখা মেলা না মাঝির। প্রেমে কাতর প্রেয়সী পথ গুনে। পেটের আগুনকে ছাপিয়ে দেহ পোড়ে তার। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র মানুষের মানচিত্র কাহিনি কাব্যে প্রেম অনবদ্য রূপ পেয়েছে। প্রেমিকের দেখা না পেলে প্রেয়সী ধুতরার বিষ খেয়ে পরান জুড়াতে চায়। প্রেমিকের পরবাস তার কাছে দুঃসহনীয় হয়ে উঠেছে।

সোমত্ত বয়স দেহে মাঝি-বউ-দিন গোনে, ফেরে না ভাতার, গলায় গামছা বাঁধা হয় নাকো তার। পেটের আগুনে পোড়ে অতপর ঘরদোর, সোনার গতর আর সব শেষে পোড়ে তার যৌবনের কড়ি। মাঝি-বউ দিন গোনে, তবু দিন গোনে…

মাঝি বউ যেন থমকে দাঁড়ায় প্রেমের ডালি নিয়ে। স্বামীর কাছে নিবেদন করে তার মনের বাসনা। দক্ষিণে পুবে কোনদিকে তার যাত্রা সবদিকেই যেন প্রেয়সীর ভয়। জীবিকার তাগিদে ছুটে চলে দূর-দূরান্ত। কিন্তু মাঝি বউয়ের পথ চেয়ে থাকা। সে পথের মাঝে দেখা দেয় বেদনার। জীবনের কাছে হেরে যায় প্রেম। দেহের ক্ষুধা নির্বৃত্ত হয় যেন।

নেশায় ঘোলাটে চোখ, টলতে টলতে যায় বুকের বাসনা, অন্ধকারে শাড়ি খোলে কারো বোন, কারো বধু, কারো বা জননী। দেহের আগুন নয়, ক্ষুধার আগুনে পোড়ে এই সব বুক, জীবনের মাংশে এক বিষফোড়া, জীবনের গভীর অসুখ।

বাস্তবতার পরশে প্রেমও থমকে যায়। দেখা দেয় গভীর অসুখ। মনের অজান্তেই যে প্রেমের কুঁড়ি ফুটেছিলো তাও শেষ হয় বাস্তবতায়।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করেছেন। গভীর থেকে জেগে ওঠা বেদনাকে যেন নিজেই উপলব্ধি করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রেমের নৈবেদ্য দুঃখের মাঝেই কূল খুঁজে পায় না। মাঝি বউ তার প্রেম নিবেদন করলেও সেই প্রেমের মাঝে হৃদয়ের গভীর ক্ষত লুকিয়ে। দূর পরবাসে স্বামীর যাত্রা কিন্তু সেই যাত্রাপথে রয়েছে দ্বিধা। বারেবারে তাকে মনে করায় তার সব দায়িত্ব। ফিরে আসার জন্য তার পথ চেয়ে থাকে। তবু জীবন গতিমুখর।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জীবনের রূপকার। একজন অন্যতম শিল্পী। প্রেমিক সত্তায় স্থান যে নারীর সেও দুঃখে কাতর। হৃদয়ের যন্ত্রণা তাই মিলিয়ে গেছে জীবনের ধারাপাতে। সমাজ, মানুষ তার লেখায় অনবদ্য হয়েছে। তাইতো আজও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ অমর, অম্লান, চিরভাস্বর।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ