Skip to content

৭ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘তাহেরা’ বাঙালি নারীর আদর্শ হোক


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৫ আগস্ট ১৯২২-১০ অক্টোবর ১৯৭১) আধুনিক, কল্পনাপ্রবণ মানুষ ছিলেন। অতি অল্পপরিমাণ সাহিত্য রচনা করেও তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। তার গল্প-উপন্যাসে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের অন্তর্লোক ও বহির্লোকের যে সূক্ষ্ম-গভীর ভাব উন্মোচন করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বিপর্যস্ত আশাহীন মৃতপ্রায় সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। প্রতিটি গল্পে উপন্যাসে উঠে এসেছে বাংলার ঘুণে ধরা সমাজের চিত্র। যা নির্মাণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ থেকেছেন অকৃপণ। এজন্যই মানবজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলো তার কলমে ভাষা পেয়েছে।

জীবনের অধিকাংশ সময় বিদেশের মাটিতে কটালেও বাংলাদেশের সমাজকে বুঝতে-জানতে তার ভুল হয়নি। আর এর ফলে চিত্রিত করেছেন অনবদ্য সৃষ্টির। তাঁর সব রচনায় পাঠকনন্দিত। তবে নাটকের ক্ষেত্রে বিশেষ জনপ্রিয় ও অনবদ্য বহিপীর (১৯৬৫)। এর কাহিনি বাংলার গ্রামীণ জীবনের অতি সাধারণ ঘটনা। তবে সাধারণের মধ্যে দিয়ে ধ্রপদী জীবন নির্দেশ করাই তার লক্ষ্য।

বহিপীর নাটকের প্রধান চরিত্র তাহেরা, বহিপীর, খোদেজা, হাতেম আলি, হাশেম। মূলত নাটকের প্লট গড়ে উড়েছে এদেরকে কেন্দ্র করেই। আলোচ্য নাটকে লেখক দুই প্রকৃতির নারীর চিত্র তুলে ধরেছেন। একজন পতিপরায়ণ, গোবেচারা টাইপ খোদেজা। অন্যজন তীব্র প্রতিবাদী তাহেরা।

কাহিনির শুরু হয়েছে জমিদারী রক্ষার্থে হাতেম আলির ঢাকায় যাত্রা পথে। তবে ঢাকার নিকটস্থ ডেমরা ঘাটে হাতেম আলির বজরায় স্থান পায় তাহেরা। এক ঝড়ের রাতে ছোট এক চাচাতো ভাইয়কে নিয়ে নদীর ঘাটে আসে সে। তাহেরা নামের এই তরুণীকে তার সৎ মা এবং বাবা মিলে তাদেরই মুরিদ এক পীরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। বুড়ো বহিপীরের সঙ্গে তাহেরার বিয়ে হলেও কোনদিন তার ঘর করেনি। এমনকি সেবাও করেনি। বিয়ের রাতেই সে পালিয়ে এসে এই বজরায় স্থান পায়। কিন্তু ভাগ্যচক্রে বহিপীর এবং তার ভৃত্য হকিকুল্লাহ একই বজরায় স্থান পায়। জমিদার হাতেম আলির ছেলে হাশেম তাহেরার পক্ষাবলম্বন করলেও তার মা খেদেজা তাহেরার সম্পর্কে জানতে পেরে খুবই বিরক্ত হয়। এবং তাহেরা যে ভালো নয় এ সম্পর্কে তার কোনই সন্দেহ থাকে না। খোদেজা আবহমান নারীর চেতনাপুষ্ট। সে জানে বিয়ে হলে সংসার করতে হয়। স্বামীর বয়স বেশি হোক বা তার আর কোনও সমস্যা থাক। বিয়ে মানেই তার কাছে মেনে নিয়ে মুখ বুজে জীবন পার করে দেওয়া। কিন্তু তাহেরা সে জীবনে বিশ্বাসী নয়। সে স্বাধীনচেতা নারী। যে কি না সামাজের গড়ে ওঠা প্রথার তোয়াক্কা করে না। বিয়ে নামক সম্পর্কেই নিজেকে আটকে রেখে সৎ মা – বাবার মুরিদের সঙ্গে জীবন পার করে দিতে নারাজ। তাইতো খোদেজার উদ্দেশ্য বলে ওঠে:

তাহেরা: (হেসে) আপনার তো বুড়োর কাছে বিয়ে হয়নি, আপনি কী করে বুঝবেন কেন বা কী করে পালিয়েছি।
খোদেজা : (বিস্ময়ে) কথা শোনো! বুড়োর কাছে বিয়ে হলেই এমন করে পালায় নাকি কেউ? বিয়ে হলো তগদিরের কথা। কারও ভালো দুলা জোটে, কারও জোটে না, কেউ স্বাস্থ্য সম্পদ সবই পায়, কেউ পায় না। তাই বলে পালাতে হবে নাকি? ওটা কত বড় গুনাহ্ তা বোঝা না?

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাঙালি নারীর এরূপ নির্ভীক চিত্র তুলে ধরে আবহমান চিন্তার বুকে পদাঘাত করলেন। নারী মানেই কারো হাতের খেলার পুতুল নয়৷ নারীর জীবনের নাটাই তার হাতেই দিয়েছেন ওয়ালীউল্লাহ্। বাঙালি নারীরা হয়ে উঠুক তাহেরা আদর্শ প্রসূত। শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে হয়ে উঠুক আপসহীন।

তাহেরা এবং খোদেজার কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে দুই নারীর মানসিকতার পূর্ণ রূপায়ণ করেছেন নাট্যকার। তবে তাহেরা যতটা প্রগতিশীল, আত্মনির্ভরশীল, স্বাধীনচেতা মননের অধিকারী ঠিক ততটাই নির্ভরশীল, কূপমুন্ডুকতায় বিশ্বাসী খোদেজা। তার কাছে স্বামীই ধর্ম। তার পদ সেবা করেই নারীর জীবন ধন্য। কিন্তু তাহেরা প্রতিবাদী ফলে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেনি কোথাও। এমনকি মিথ্যা সম্পর্কের বলি হতেও সে রাজি হয়নি। বজরায় যখন বহিপীর তার সন্ধান পায় এবং জানতে পারে এখানেই তার বিবি উপস্থিত তখন সে তাকে মীমাংসায় পৌঁছানোর তাগিদ দেয়। খোদেজা, হাতেম আলিও বহিপীরকে সাহায্য করতে চাইলে তাহেরা বলে-

তাহেরা: খবরদার এদিকে কেউ আসবেন না, এলেই আমি পানিতে ঝাঁপ দেবো। আমি সাঁতার জানি না, পানিতে ডুবে মরব।
বহিপীরের সঙ্গে সংসার করার থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মরা তাহেরার কাছে উত্তম মনে হয়েছে। কৌশলে তাহেরা তার আস্তানায় নিতে চায়। এজন্য নানাকৌশল অবলম্বন করেও ব্যর্থ হয় বহিপীর। তবে হাশেমের মনেও তাহেরার প্রতি ধীরে ধরে ভালোবাসার জন্ম নেয়। একসময় বহিপীর লক্ষ করে তাহেরা তার প্রতি উদাসীন কিন্তু হাশেম তাহেরার প্রতি নিবেদিত।
হাশেম: আমি বলতে চাই যে যতই ফন্দি কৌশল আঁটেন না কেন, আমি দেখব যাতে তাঁর কোন ফন্দি কৌশল না খাটে, কারণ ওর যদি মত থাকে, তবে তাকে আমি বিয়ে করব।

তাহেরা একজন নারী হয়েও কোথাও দমে যায়নি। একাই নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়েছে। বহিপীরের সঙ্গে সংসারে আপত্তি থাকায় সেখানে যেতে চায়নি। তা স্পষ্টভাবেই বহিপীরের উদ্দেশ্যেও বলেছে। তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার সৎ মা, বাবা তাদের মুরিদিয়ানা রক্ষায় মেয়েকে অপাত্রে দান করেছেন। সে তো কোরবানির গরু নয় তা স্পষ্টই জানিয়ে দেয় বহিপীরের উদ্দেশ্যে।

তাহেরা: আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না। আমার বাপজান আর সৎ মা আপনাকে খুশি করার জন্য আপনার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। আমি যেন কোরবানির বকরি। আপনি পুলিশে খবর দিতে পারেন। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে যাবো না। আপনি আমাকে দেখেননি, আর আমিও আপনাকে দেখিনি। আর আপনাকে আমি দেখতেও চাই না।

তাহেরার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর প্রথার সমীকরণ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছুপা হয়নি। খোদেজা পতিপরয়াণার, দুর্বল চিত্তের অধিকারী। স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনায় যার জীবনের লক্ষ। যার কাছে বহিপীরের সংসার না করে পালানো গুনাহের কাজ! অপরদিকে তাহেরা নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, সাহসী এবং অন্যায়ের সঙ্গে আপোষহীন। নিজের মতের গুরুত্ব যার কাছে সর্বোচ্চ স্থান পেয়েছে। ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মনের বিরুদ্ধে নিজেকে শেষ করে দিতে প্রস্তুত নয় তাহেরা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাঙালি নারীর এরূপ নির্ভীক চিত্র তুলে ধরে আবহমান চিন্তার বুকে পদাঘাত করলেন। নারী মানেই কারো হাতের খেলার পুতুল নয়৷ নারীর জীবনের নাটাই তার হাতেই দিয়েছেন ওয়ালীউল্লাহ্। বাঙালি নারীরা হয়ে উঠুক তাহেরা আদর্শ প্রসূত। শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে হয়ে উঠুক আপসহীন।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ